Posts

Showing posts from 2017

প্রশ্ন–উত্তর–প্রশ্ন

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ত্রুটি হল, এখানে যে বেশি জানে সে প্রশ্ন করে, আর যে কম জানে সে উত্তর দেয়। শিক্ষক প্রশ্ন করে আর ছাত্র উত্তর দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রদের প্রশ্ন করতে শেখানো হয় না; শেখানো হয়, কি করে প্রশ্নের উত্তর লিখতে হয়। একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে প্রশ্ন করার সহজাত ক্ষমতা নিয়ে, প্রশ্ন করার মধ্য দিয়েই সে পৃথিবীকে জানতে চায়। অজস্র প্রশ্ন দিয়ে পিতামাতাকে অতিষ্ঠ করে তুলে। পরবর্তীতে, ধীরে ধীরে যতই সে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে, ততই প্রশ্ন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে থাকে। অবশেষে, যখন সে সাফল্যের সহিত পাঠ্যক্রম সমাপ্ত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসে, তখন তার আর কোনও প্রশ্ন থাকে না, যেন সব প্রশ্নের উত্তর সে ইতিমধ্যে জেনে গেছে। একটি প্রশ্নের উত্তর যে আরেকটি প্রশ্ন দিয়ে করা যায়, এবং প্রশ্নের উত্তরের উপরও যে প্রশ্ন করা যায়, সে কথাটা একদম শেখানো হয় না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কারণ, রাষ্ট্র ধর্ম সমাজ সর্বত্র মানুষ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। প্রকৃতি মানুষকে দিয়েছে প্রশ্ন করার ক্ষমতা সত্যকে জানার জন্য, আর সমাজ তা কেড়ে নিয়েছে কায়েমি বন্দোবস্ত নিরাপদ রাখা...

দক্ষিণ দুয়ারী ঘর

প্রাচীন কাল থেকেই দক্ষিণ-দুয়ারী ঘর সমাদৃত হয়ে আসছে। প্রাচীন স্থাপত্যবিদ্যা ভারতীয় 'বাস্তুশাস্ত্র' এবং চীন দেশীয় ‘ফেং-শুই’-তে দক্ষিণ দুয়ারী ঘরের সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলার খনার বচনে বলা হয়েছে: ‘দক্ষিণ দুয়ারী ঘরের রাজা, পূব দুয়ারী তাহার প্রজা পশ্চিম দুয়ারীর মুখে ছাই, উত্তর দুয়ারীর খাজনা নাই।’ দক্ষিণ দুয়ারী ঘর সমাদৃত হওয়ার অন্যতম কারণ বোধ হয় দখিন-হাওয়া। দক্ষিণ সমুদ্রের সজল বাতাস অনায়াসে গৃহে প্রবেশ করে দেহমন সতেজ করবে সেটাই হয়ত সবার আকাংখা। কিন্তু জনাকীর্ণ ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে সবসময় দক্ষিণ দিকে দরজা রেখে গৃহ নির্মাণ করা নিশ্চয়ই দুরূহ ব্যাপার। তবে কেউ যদি ঘর বাঁধতে চায় ঠিক উত্তর মেরুতে তা হলে আর ভাবনার কিছু নেই। কারণ সেখানে ঘরের দরজা যে দিকেই হোক না কেন তা হবে দক্ষিণমুখী। উত্তর মেরুতে নির্মিত ঘর যদি হয় চার দেয়ালের, আর প্রত্যেক দেয়ালে থাকে একটি করে দরজা তা হলে চারটি দরজাই হবে দক্ষিণমুখী, এবং সবকটি দরজা দিয়েই বইবে দখিন হাওয়া — প্রাণসঞ্জীবনী দখিন হাওয়া।  ▣ ✍ অসীম দে গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা  

মাটির প্রদীপ

Image
মাটির প্রদীপ আমাদের সংস্কৃতিতে সুপ্রাচীন কাল থেকেই পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পূজার্চনা , মঙ্গলকামনা , কিংবা শ্রদ্ধা জানাতে মাটির প্রদীপ জ্বালানো হয়। প্রদীপের মাটির অংশটি পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করে , আর শিখাটি দেবলোকের। গ্রীক পুরাণের প্রমিথিউস দেবলোক থেকে আগুন চুরি করে মর্তের মানুষকে উপহার দিয়েছিলেন , এই আগুন দেবলোকের ধন। আগুনের শিখা সবসময় ঊর্ধ্বাভিমুখী , এক দিব্যসত্তার প্রতীক। মাটির প্রদীপ রবীন্দ্রনাথের গানে আছে — ‘আমার এই দেহখানি তুলে ধরো , তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো’। মাটির প্রদীপ মানবদেহের প্রতীক ; বৃষ্টির জল আর মাটি দিয়ে তৈরি হয় মানুষের দেহ , আর দেবলোকের আগুনে প্রাণের প্রদীপ জ্বেলে মানুষ পৃথিবীতে আসে। মানুষের দেহ এই পৃথিবীর , কিন্তু প্রাণের শিখাটি দেবলোকের। এই পার্থিব দেহ ও ঐশী শিখার সম্মিলনে মানুষ সৃষ্টি হয়। প্রতিটি মানুষ যেন এক-একটি মাটির প্রদীপ — নশ্বর কাদামাটির আধারে অবিনশ্বর আগুনের চৈতন্যশিখা। এই চৈতন্যশিখাকে কেউ বলেন চৈতন্য , কেউ বলেন আত্মা , বাউল সাধকরা বলেন ‘অধর মানুষ’। জাতি , ধর্ম , বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল মানুষের দেহে প্রদীপ্ত প্রাণের একই চৈতন্যশিখা...

গানের ভিতর দিয়ে

Image
এই বিশ্বজগৎ এক বিশাল বাদ্যযন্ত্র। এমনটিই মনে করতেন খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকের গ্রীক গণিতবিদ , দার্শনিক ও সংগীততাত্ত্বিক পিথাগোরাস। আর এই বাদ্যযন্ত্র থেকে যে পবিত্র সংগীত সৃষ্টি হয় তাকে বলতেন ‘ মিউজিক অব দ্য স্ফেয়ার ’, বা মণ্ডলা-সংগীত। পিথাগোরাসের কল্পনায় এই বাদ্যযন্ত্র ছিল হার্পজাতীয় তারবাদ্য। যেখানে ‘ স্ট্রিং ’ বা তারে কম্পন তুলে সুর সৃষ্টি করা হত।    একই ধরণের কথা বলেন স্ট্রিং-তত্ত্বের অনুসারী পদার্থবিজ্ঞানীরা। তাঁদের দাবি , এই বিশ্বজগৎ হচ্ছে কম্পমান তারের সিম্ফনি বা ঐকতান-সংগীত। স্ট্রিং-তত্ত্ব হচ্ছে বিশ্বজগৎ সৃষ্টির আধুনিকতম তত্ত্ব। এই তত্ত্বের মূল ধারণা — বিশ্বজগতের সমস্ত বস্তু ও শক্তি এক ধরণের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ‘ স্ট্রিং ’ বা তার দিয়ে গঠিত। সামবেদ-এর সামবিধান ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে , সমস্ত জগৎ সাত সুরের সংগীত প্রবাহে বিধৃত। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব-বীণার কথা বলেছেন , যে বীণার ঝংকারে অনন্ত আকাশের সমস্ত নক্ষত্রলোক ঝংকৃত হয়ে অপূর্ব ‘ নৈঃশব্দ্য-সংগীত ’- এ গাঁথা পড়ছে। পারস্যের সুফি মরমী কবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি বলতেন , আমরা এমন এক জায়গায় এসে পড়েছি যেখানে সবকিছুই সংগীত। আকাশ ভরে আছ...

অমৃতের সন্তান

প্রাচীন উপনিষদে মানুষকে ‘অমৃতের সন্তান’ বলা হয়েছে। এই ধারণা অনুযায়ী , মানুষ ঈশ্বরের সন্তান , যিনি তাঁর অবয়ব ও গুণাবলী মানুষকে দিয়েছেন। যদিও ঈশ্বরের প্রকৃত অবয়ব সম্পর্কে মানুষের কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই , তবু কল্পনার জগতে মানুষ যুগে যুগে তাঁর রূপ অঙ্কন করেছে। প্রাচীন গ্রিক ও ভারতীয় পুরাণে দেবদেবীদের রূপ মানুষের মতোই। এমনকী নিরাকার ঈশ্বরকেও মানুষের মতো কথা বলতে , বিচারকার্য সম্পাদন করতে এবং সিংহাসনে অধিষ্ঠিত অবস্থায় চিত্রিত করা হয়েছে। লালন ফকির তাঁর ঈশ্বরকে ‘আরশিনগরের’ অধিবাসী বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন , ঈশ্বরকে তিনি পৃথক সত্তা হিসেবে দেখেননি ; বরং আরশির পটে যে প্রতিচ্ছবি দেখা যায় , তা তাঁর নিজেরই প্রতিবিম্ব। বাইবেলে বলা হয়েছে , ঈশ্বর মানুষকে তাঁর নিজের অবয়বে সৃষ্টি করেছেন। অন্যদিকে , জার্মান দার্শনিক লুদভিগ ফুয়েরবাখ বলেছেন , ‘ It is not as in the Bible, that God created man in his own image. But on the contrary, man created God in his own image.’ অর্থাৎ , ফুয়েরবাখের মতে , ঈশ্বর নন , বরং মানুষই ঈশ্বরকে তার নিজের অবয়বে সৃষ্টি করেছে। এই দুই মতবাদের মধ্যে ব...

বিশ্বাসের শক্তি — রোগে ও আরোগ্যে

এক আদি গল্প: বিশ্বাসে আরোগ্য প্রায় দুই হাজার বছর আগের ঘটনা। এক নারী , জনতার ভিড় ঠেলে যীশুখ্রিষ্টের কাছে গিয়ে তাঁর বস্ত্র স্পর্শ করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছিলেন। কিন্তু যীশুর বস্ত্র ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সুস্থ হয়ে যান। যীশু তখন বলেছিলেন , “ তোমার বিশ্বাসই তোমাকে আরোগ্য দিয়েছে।” এই প্রাচীন কাহিনি আমাদের মনে করিয়ে দেয় — বিশ্বাস কেবল মনের অনুভব নয় , এটি বাস্তব রূপে দেহ ও জীবনের উপর প্রভাব ফেলে । বিশ্বাস: সৃষ্টি ও বিনাশের শক্তি মানুষ অসংখ্য বিষয়ে বিশ্বাস করে। কিন্তু সেই বিশ্বাসের প্রভাব কতটা গভীর হতে পারে , তা আমরা সবসময় উপলব্ধি করি না। বিশ্বাসের শক্তি এমনই — তা মানুষকে সাধুতে রূপান্তর করতে পারে , আবার হিংস্র রূপেও গড়ে তুলতে পারে। বিশ্বাস দেহের মধ্যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে পারে , রোগ সৃষ্টি করতে পারে , আবার তা নিরাময়ও ঘটাতে পারে । ভয়ের জন্ম , রোগের সূচনা: একটি গল্প এক ব্যক্তি মুখ খোলা রেখে দীর্ঘদিন ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমোতেন। কোনও সমস্যা হয়নি কখনও। একদিন এক অতিথি এসে তাকে সতর্ক করলেন , “ মুখ খোলা রেখে ঘুমোলে মুখে মাছি ঢুকে যেতে পারে!” এই একট...

বাসন্তী কানন

Image
বসন্ত এল বলে কানন সেজেছে ফুলে ফুলে, ফুলেরা সেজেছে রঙে রসে সুবাসে ।           কিন্তু তুমি না এলে           এসব অর্থহীন ।                     আর তুমি এলে,                     এসব   — অর্থহীন! বাসন্তী কানন ✍ অসীম দে গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা   মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি’র ‘কাম টু দ্য অরচার্ড ইন স্প্রিং’ অনুসৃত ।

নৈঃশব্দ্য সংগীত

মানুষ যে ভাষায় কথা বলে , তা সংকীর্ণ অর্থের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ। মানব মননের গভীরতর আবেগ ও অনুভূতি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করার জন্য এই ভাষা যথেষ্ট নয়। ‘ভালবাসি’ শব্দটির কথাই ধরা যাক। আমরা ফুল ভালবাসি , প্রিয়জনকে ভালবাসি , ঈশ্বরকেও ভালবাসি। কিন্তু সব ভালবাসার প্রকৃতি কি একরকম ? ভালবাসার তীব্রতা প্রকাশ করতে আমরা ‘বেশি’ , ‘ আরও বেশি’ , ‘ সবচেয়ে বেশি’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করি। কিন্তু তার চেয়েও গভীর অনুভূতি প্রকাশের জন্য ভাষা যেন পর্যাপ্ত নয়। এই সীমাবদ্ধতা কিছুটা দূর হয় , যখন ভাষার সঙ্গে যুক্ত হয় ছন্দ ও সুর ; তখন জন্ম নেয় কবিতা ও গান । প্রাচীনকালে ছন্দ-সুরের প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল মহর্ষি বাল্মীকির হৃদয়ের গভীর বেদনা থেকে। তিনি বলেছিলেন , ‘ মানবের জীর্ণ বাক্যে মোর ছন্দ দিবে নব সুর , অর্থের বন্ধন হতে নিয়ে তারে যাবে কিছু দূর।’ ভাষা অর্থের সীমাবদ্ধতার মধ্যে বন্দী। ভাষাকে এই সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করার জন্যই সুরের সংযোজন ঘটে। ফলে , বাণী ও সুরের সংমিশ্রণে জন্ম নেয় সংগীত , যা মনের ভাব প্রকাশের জন্য আরও বৃহত্তর পরিসর সৃষ্টি করে । তবে বাণী ও সুরের ভাবপ্রকাশের ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ। যখন মনের অনুভূতি গভীরতর হত...