অমৃতের সন্তান

প্রাচীন উপনিষদে মানুষকে ‘অমৃতের সন্তান’ বলা হয়েছে। এই ধারণা অনুযায়ী, মানুষ ঈশ্বরের সন্তান, যিনি তাঁর অবয়ব ও গুণাবলী মানুষকে দিয়েছেন। যদিও ঈশ্বরের প্রকৃত অবয়ব সম্পর্কে মানুষের কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই, তবু কল্পনার জগতে মানুষ যুগে যুগে তাঁর রূপ অঙ্কন করেছে।

প্রাচীন গ্রিক ও ভারতীয় পুরাণে দেবদেবীদের রূপ মানুষের মতোই। এমনকী নিরাকার ঈশ্বরকেও মানুষের মতো কথা বলতে, বিচারকার্য সম্পাদন করতে এবং সিংহাসনে অধিষ্ঠিত অবস্থায় চিত্রিত করা হয়েছে। লালন ফকির তাঁর ঈশ্বরকে ‘আরশিনগরের’ অধিবাসী বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ঈশ্বরকে তিনি পৃথক সত্তা হিসেবে দেখেননি; বরং আরশির পটে যে প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, তা তাঁর নিজেরই প্রতিবিম্ব। বাইবেলে বলা হয়েছে, ঈশ্বর মানুষকে তাঁর নিজের অবয়বে সৃষ্টি করেছেন।

অন্যদিকে, জার্মান দার্শনিক লুদভিগ ফুয়েরবাখ বলেছেন, It is not as in the Bible, that God created man in his own image. But on the contrary, man created God in his own image.’ অর্থাৎ, ফুয়েরবাখের মতে, ঈশ্বর নন, বরং মানুষই ঈশ্বরকে তার নিজের অবয়বে সৃষ্টি করেছে।

এই দুই মতবাদের মধ্যে বিরোধ থাকলেও একটি বিষয়ে তারা একমত — ঈশ্বর ও মানুষের চেহারার মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, যদি ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে কি তিনি কেবল তাঁর দৈহিক অবয়ব দিয়েই সন্তুষ্ট হয়েছেন? নিশ্চয়ই নয়। তিনি মানুষের দেহে প্রাণের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছেন এবং তাঁর চেতনায় যোগ করেছেন ঐশ্বরিক গুণাবলী।

ঐশ্বরিক গুণাবলী ও মনুষ্যত্ব

ঐশ্বরিক গুণাবলীর মধ্যে রয়েছে প্রতিভা, সৃজনশীলতা, প্রেম, দয়া, মায়া, করুণা ও ক্ষমা। এই গুণাবলী অন্যান্য জীবের মধ্যে অনুপস্থিত। এ কারণেই মানুষকে ‘অমৃতের সন্তান’ এবং ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ বলা হয়।

ঐশ্বরিক গুণাবলীর আরেক নাম ‘ঈশ্বরত্ব। যখন বলা হয়, মানুষের মধ্যে ঈশ্বর বিরাজ করেন, তখন মূলত ঈশ্বরত্বের কথাই বোঝানো হয়। এখানে গড বলতে কোনও সত্তাকে নয়, বরং গডলিনেস বা ঈশ্বরীয় গুণাবলীকেই বোঝানো হয়েছে। ঈশ্বরত্ব যখন মানুষের মধ্যে প্রকাশ পায়, তখন তা মনুষ্যত্বে রূপ নেয়। সেই সময় স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালবাসা, দয়া, সহমর্মিতা, প্রতিভা এবং সৃজনশীলতা মানবিক গুণাবলী হিসেবে প্রকাশিত হয়।

ঐশ্বরিক গুণাবলী মানুষের চেতনায় সুপ্ত অবস্থায় থাকে। আন্তরিক ইচ্ছাশক্তি ও নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে এই গুণাবলীর জাগরণ সম্ভব। অন্তর্নিহিত ঈশ্বরত্ব জাগ্রত করার সাধনাই মানবজাতির প্রকৃত ধর্ম, যা মনুষ্যত্ব নামে পরিচিত।

মনুষ্যত্ব: প্রকৃত ধর্ম

মনুষ্যত্বই মানুষের প্রকৃত ধর্ম। এটি এক ও অদ্বিতীয়। এই ধর্ম অনুসারে কেউই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হতে পারে না, ধর্মহীন তো নয়ই। মনুষ্যত্ব জাগ্রত করাই মানুষের আসল সাধনা এবং এই সাধনাই মানবজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। 

অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা 

Popular posts from this blog

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চেনার উপায়

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা — চন্দ্রসূর্যের মিলন ও বিরহ তিথি

তেলের সামাজিক মাহাত্ম্য

ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ

রাসলীলা মাহাত্ম্য

আঁধারের রূপ ও বিপন্নতা

আধ্যাত্মিকতা — পাশ্চাত্য ভাবধারার আলোকে

সূর্য উপাসনা

হৃদয়-দর্পনে দেখা