বিশ্বাসের শক্তি — রোগে ও আরোগ্যে
এক আদি গল্প: বিশ্বাসে আরোগ্য
প্রায় দুই হাজার বছর আগের ঘটনা। এক নারী, জনতার ভিড় ঠেলে যীশুখ্রিষ্টের
কাছে গিয়ে তাঁর বস্ত্র স্পর্শ করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে
ভুগছিলেন। কিন্তু যীশুর বস্ত্র ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সুস্থ হয়ে যান। যীশু তখন
বলেছিলেন, “তোমার বিশ্বাসই তোমাকে আরোগ্য দিয়েছে।”
এই প্রাচীন কাহিনি আমাদের মনে করিয়ে দেয় — বিশ্বাস
কেবল মনের অনুভব নয়, এটি বাস্তব রূপে দেহ ও জীবনের উপর প্রভাব ফেলে।
বিশ্বাস: সৃষ্টি ও বিনাশের শক্তি
মানুষ অসংখ্য বিষয়ে বিশ্বাস করে। কিন্তু সেই
বিশ্বাসের প্রভাব কতটা গভীর হতে পারে, তা আমরা সবসময় উপলব্ধি করি না। বিশ্বাসের শক্তি এমনই — তা
মানুষকে সাধুতে রূপান্তর করতে পারে, আবার হিংস্র রূপেও গড়ে
তুলতে পারে। বিশ্বাস দেহের মধ্যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে পারে,
রোগ সৃষ্টি করতে পারে, আবার তা নিরাময়ও ঘটাতে
পারে।
ভয়ের জন্ম, রোগের সূচনা: একটি গল্প
একদিন হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে তার মনে হল, শরীরের ভেতরে সত্যিই একটি মাছি
ছুটোছুটি করছে। অসহ্য অস্বস্তি নিয়ে সে শহরের নামীদামী ডাক্তারদের দ্বারস্থ হল।
বিভিন্ন স্ক্যান, আলট্রাসনোগ্রাফি — সবই করানো হল। কোথাও
কোনও মাছির চিহ্ন নেই।
কিন্তু তার বিশ্বাস ছিল অটুট — মাছি শরীরের
মধ্যে আছে এবং সেখান থেকেই তার যন্ত্রণা। ডাক্তারদের ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে না পেরে
সে আশ্রয় নিল এক সাধুর।
চিকিৎসা নাকি বিশ্বাস-নির্ভর কৌশল?
সাধু মনোযোগ দিয়ে তার গল্প শুনে তাকে শোয়ালেন।
শরীরের নানা অংশে কান পেতে শোনার অভিনয় করলেন। হঠাৎ হাঁটুর কাছে কান দিয়ে চমকে উঠে
বললেন, “এই তো! মাছিটি হাঁটুর গিঁটের
মধ্যে লুকিয়ে আছে।”
এরপর কিছু ‘কেরামতি’ করে তিনি একটি মাছি বের করে
আনলেন। বললেন, “এই তো সেই
মাছি, যা এতদিন তোকে জ্বালিয়ে তুলেছিল। এখন তুই সম্পূর্ণ
সুস্থ।”
রোগী বিস্ময়ে অভিভূত। সাধুকে প্রণাম করল। তারপর
ছুটে গেল ডাক্তারদের কাছে — “তোমরা যা পারোনি, সাধুবাবা তা করেছেন!”
বিজ্ঞান কি সবসময় এক ও অচঞ্চল?
তাই বিজ্ঞানসম্মত সত্য মানেই সর্বকালীন
অপরিবর্তনীয় নয় — বিশেষ প্রেক্ষিতে যা কার্যকর, সেটিই আপাত সত্য। সেই অর্থে বিশ্বাস যদি রোগ নিরাময়ে কার্যকর
হয়, তবে সেটিও এক ধরনের প্রযোজ্য সত্য।
মন, দেহ ও বিশ্বাস: আধুনিক চিকিৎসায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ্বাসের ভূমিকা নিয়ে
বিস্তর গবেষণা হচ্ছে। ‘মন ও দেহ’ সম্পর্কিত চিকিৎসাশাস্ত্রে (Psychosomatic Medicine) এই
বিশ্বাসের প্রভাবকে বিজ্ঞান সম্মতভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে দুটি পরিভাষায় —
- Nocebo Effect (নসিবো ইফেক্ট)
- Placebo Effect (প্লাসিবো ইফেক্ট)
নসিবো ইফেক্ট: বিশ্বাস থেকেই রোগ
যখন রোগী কোনও ওষুধ সেবনের আগে তার
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে এতটাই চিন্তিত হয়ে পড়ে যে সেই প্রতিক্রিয়াগুলিই প্রকট
হয়ে ওঠে, তখন তাকে বলে নসিবো ইফেক্ট। মূল ওষুধ কোনও কাজ না করলেও, নেতিবাচক প্রত্যাশা থেকেই রোগ প্রকাশ পায়।
প্লাসিবো ইফেক্ট: বিশ্বাসেই আরোগ্য
একজন অনিদ্রার রোগীকে যদি সাধারণ ভিটামিন
ট্যাবলেট দিয়ে বলা হয় এটি অত্যন্ত কার্যকর ঘুমের ওষুধ, এবং সে যদি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে,
তবে তার ঘুম এসে যেতে পারে। এটিই প্লাসিবো ইফেক্ট — যেখানে বিশ্বাসই রোগ নিরাময়ের কাজ করে।
লোকজ চিকিৎসা ও বিশ্বাস: পুরাতন পথেও রয়েছে
বিজ্ঞান
বিশ্বাস কি তবে চিকিৎসার অংশ?
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী ব্রুস
লিপ্টন বলেন:
"If the brain expects that a treatment
will work, it sends healing chemicals into the bloodstream, which facilitates
that. That’s why the placebo effect is so powerful for every type of healing.
And the opposite is equally true and equally powerful: when the brain expects
that a therapy will not work, it does not. It is called the ‘nocebo effect’."
অর্থাৎ, মানুষের মস্তিষ্ক যদি কোনও চিকিৎসা সম্পর্কে ইতিবাচক
প্রত্যাশা পোষণ করে, তাহলে শরীর নিজে থেকেই নিরাময়মূলক
রাসায়নিক তৈরি করে। আবার যদি মনে করে চিকিৎসা ব্যর্থ হবে, তাহলে
সেটি বাস্তবেও কাজ করে না।
শেষ কথা: বিশ্বাসের কাছে বিজ্ঞানেরও মাথা নত?