Posts

ভালবাসা কারে কয়

‘ ভালবাসা ’ একটি মিলিত শব্দ ; ‘ ভাল ’ ও ‘ বাসা ’ এই শব্দ দুটির মিলনে এর সৃষ্টি । ‘ বাসা ’ বা ‘ বাস্ ’ ধাতুর একটি অর্থ ‘ সুগন্ধ ’ । কাউকে ভালবাসলে তার বুকে আতরের সুবাস হয় , তখন আলাদা সুগন্ধির প্রয়োজন হয় না । বর্তমানে ‘ ভালবাসা ’ শব্দটি ইংরেজি ‘ লাভ ’ ­ এর প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে । কিন্তু দুশো বছর আগে বাংলা ভাষায় , ‘ লাভ ’, এই বিশিষ্ট অর্থে ‘ ভালবাসা ’ ব্যবহৃত হতো না , এমনটি জানিয়েছেন বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় । তখন এর অর্থ ছিল , ‘ ভাল বলে অনুভব করা , ভাল মনে করা ’ । ‘ ভাল - বাসা ’ শব্দের ‘ বাসা ’ বা ‘ বাস্ ’ ধাতু , ‘ বোধ করা ’ অর্থে প্রযুক্ত হতো । পুরাতন বাংলায় ‘ ভালবাসা ’ র পাশাপাশি ‘ মন্দ - বাসা ’, ‘ ভয় - বাসা ’, ‘ ঘৃণা - বাসা ’, ‘ লজ্জা - বাসা ’, ‘ দুঃখ - বাসা ’ প্রভৃতি শব্দ প্রচলিত ছিল । তখন সংস্কৃত শব্দ ‘ প্রীতি ’ র বাংলা সংস্করণ ‘ পিরীতি ’ ও ‘ পিরীত ’ শব্দ দুটি প্রেম - প্রনয় অর্থে বেশ জনপ্রিয় ছিল । এখন ‘ প্রেম বা প্রনয় বা ভালবাসা ’ অর্থে ভদ্র - সমাজে ‘ পিরীত ’ শব্দের ব্যবহার অশিষ্ট ব ’ লে বিবেচিত হয় । আজ ‘ পিরীত ’ শব্দটি আগের মর্যাদা হারি

আলেকজান্ডার ও দিওগেনেস — জীবনের অন্তিম লক্ষ্য

Image
প্রায় দুই হাজার বছর আগে গ্রিসদেশে দিওগেনেস নামে এক দার্শনিক ছিলেন । অদ্ভুত ছিল তাঁর আচরণ ; তিনি দিনের বেলায় আলো হাতে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন , বলতেন , একজন সৎ মানুষ খুঁজছেন । জনগণ তাঁকে সাধু মনে করত । একই সময়ে সে – দেশে ছিলেন একজন প্রতিভাধর যোদ্ধা , যিনি ‘ মহান আলেকজান্ডার ’ নামে সারা বিশ্বে পরিচিত । তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল একদিকে বলকান থেকে হিমালয় , আরেক দিকে মিশর থেকে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত । গ্রীষ্মের এক দুপুরে নদীর ধারে বৃক্ষের নিচে বিবস্ত্র হয়ে আরাম করছিলেন দিওগেনেস । হঠাৎ লক্ষ্য করলেন , কে যেন ঘোড়ায় চড়ে তাঁর দিকে আসছে । কিছুক্ষণ পরই বুঝতে পারলেন , লোকটি আর কেউ নয় — স্বয়ং ‘ আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ’ । আর তিনি এও বুঝলেন যে , আলেকজান্ডার আবার নতুন কোনও দেশ দখল করতে যাচ্ছে । কারণ প্রতিবারই নতুন কোনও দেশ আক্রমণ করতে যাওয়ার আগে আলেকজান্ডার আসেন দিওগেনেসের কাছে আশীর্বাদ নিতে । আলেকজান্ডার অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন দিওগেনেসকে । এমনটাও বলতেন যে , পরজন্মে সুযোগ পেলে আলেকজান্ডার নয় , দিওগেনেস হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে চান তিনি । কাছে এসে মাথা নত করে আলেকজান্ডার গুরুদেবকে অভ

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

Image
এই বিশ্ব ঈশ্বরের প্রকাশিত রূপ , আর ঈশ্বর — এই বিশ্বের অপ্রকাশিত রূপ। প্রত্যেক বস্তুর রয়েছে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য রূপ। যা প্রকাশ্য তা সীমা দ্বারা বেষ্টিত , অর্থাৎ সসীম। আর যা অপ্রকাশ্য তা সীমার অতীত , অর্থাৎ অসীম। ঈশ্বর নিরাকার , কিন্তু সৃষ্টির লীলা চরিতার্থ করার জন্য তিনি যে-কোনও আকার ধারণ করতে পারেন। যখন তিনি কোনও আকার ধারণ করেন , অর্থাৎ সীমা গ্রহণ করেন , তখন কোনও কিছুর সৃষ্টি হয়। সীমাই সৃষ্টি , আর ' অসীম ' — সকল সৃষ্টির উৎস। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন , ‘The revelation of the infinite in the finite is the motive of all creation.’ সীমার মধ্যে ‘অসীম’ নিজেকে প্রকাশ করবে সেটাই সমস্ত সৃষ্টির মূলভাব। সমস্ত সৃষ্টি তাঁরই অভিব্যক্ত রূপ। সীমা ও অসীম পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও বিরুদ্ধ নয় ; একটি থাকলে আরেকটি থাকবেই। সীমা ও অসীমের সম্পর্কটি পারস্পরিক—প্রেমের ও আনন্দের। অর্থাৎ , ' সীমা অসীমের পক্ষে যতখানি , অসীমও সীমার পক্ষে ততখানি ; উভয়ের উভয়কে নহিলে নয় ' । তাই , অসীমের আনন্দ সীমার উপর নির্ভরশীল , সীমা না থাকলে অসীমের প্রেম মিথ্যে হয়ে যেত। যিনি অসীম , তিনি সীমার দ্বারাই নিজেকে প্রকাশ কর

প্রশ্ন–উত্তর–প্রশ্ন

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ত্রুটি হল, এখানে যে বেশি জানে সে প্রশ্ন করে, আর যে কম জানে সে উত্তর দেয়। শিক্ষক প্রশ্ন করে আর ছাত্র উত্তর দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রদের প্রশ্ন করতে শেখানো হয় না; শেখানো হয়, কি করে প্রশ্নের উত্তর লিখতে হয়। একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে প্রশ্ন করার সহজাত ক্ষমতা নিয়ে, প্রশ্ন করার মধ্য দিয়েই সে পৃথিবীকে জানতে চায়। অজস্র প্রশ্ন দিয়ে পিতামাতাকে অতিষ্ঠ করে তুলে। পরবর্তীতে, ধীরে ধীরে যতই সে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে, ততই প্রশ্ন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে থাকে। অবশেষে, যখন সে সাফল্যের সহিত পাঠ্যক্রম সমাপ্ত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসে, তখন তার আর কোনও প্রশ্ন থাকে না, যেন সব প্রশ্নের উত্তর সে ইতিমধ্যে জেনে গেছে। একটি প্রশ্নের উত্তর যে আরেকটি প্রশ্ন দিয়ে করা যায়, এবং প্রশ্নের উত্তরের উপরও যে প্রশ্ন করা যায়, সে কথাটা একদম শেখানো হয় না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কারণ, রাষ্ট্র ধর্ম সমাজ সর্বত্র মানুষ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। প্রকৃতি মানুষকে দিয়েছে প্রশ্ন করার ক্ষমতা সত্যকে জানার জন্য, আর সমাজ তা কেড়ে নিয়েছে কায়েমি বন্দোবস্ত নিরাপদ রাখা

দক্ষিণ দুয়ারী ঘর

প্রাচীন কাল থেকেই দক্ষিণ-দুয়ারী ঘর সমাদৃত হয়ে আসছে। প্রাচীন স্থাপত্যবিদ্যা ভারতীয় 'বাস্তুশাস্ত্র' এবং চীন দেশীয় ‘ফেং-শুই’-তে দক্ষিণ দুয়ারী ঘরের সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলার খনার বচনে বলা হয়েছে: ‘দক্ষিণ দুয়ারী ঘরের রাজা, পূব দুয়ারী তাহার প্রজা পশ্চিম দুয়ারীর মুখে ছাই, উত্তর দুয়ারীর খাজনা নাই।’ দক্ষিণ দুয়ারী ঘর সমাদৃত হওয়ার অন্যতম কারণ বোধ হয় দখিন-হাওয়া। দক্ষিণ সমুদ্রের সজল বাতাস অনায়াসে গৃহে প্রবেশ করে দেহমন সতেজ করবে সেটাই হয়ত সবার আকাংখা। কিন্তু জনাকীর্ণ ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে সবসময় দক্ষিণ দিকে দরজা রেখে গৃহ নির্মাণ করা নিশ্চয়ই দুরূহ ব্যাপার। তবে কেউ যদি ঘর বাঁধতে চায় ঠিক উত্তর মেরুতে তা হলে আর ভাবনার কিছু নেই। কারণ সেখানে ঘরের দরজা যে দিকেই হোক না কেন তা হবে দক্ষিণমুখী। উত্তর মেরুতে নির্মিত ঘর যদি হয় চার দেয়ালের, আর প্রত্যেক দেয়ালে থাকে একটি করে দরজা তা হলে চারটি দরজাই হবে দক্ষিণমুখী, এবং সবকটি দরজা দিয়েই বইবে দখিন হাওয়া — প্রাণসঞ্জীবনী দখিন হাওয়া।  ▣ ✍ অসীম দে গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা  

মাটির প্রদীপ

Image
মাটির প্রদীপ আমাদের সংস্কৃতিতে সুপ্রাচীন কাল থেকেই পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পূজার্চনা , মঙ্গলকামনা , কিংবা শ্রদ্ধা জানাতে মাটির প্রদীপ জ্বালানো হয়। প্রদীপের মাটির অংশটি পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করে , আর শিখাটি দেবলোকের। গ্রীক পুরাণের প্রমিথিউস দেবলোক থেকে আগুন চুরি করে মর্তের মানুষকে উপহার দিয়েছিলেন , এই আগুন দেবলোকের ধন। আগুনের শিখা সবসময় ঊর্ধ্বাভিমুখী , এক দিব্যসত্তার প্রতীক। মাটির প্রদীপ রবীন্দ্রনাথের গানে আছে — ‘আমার এই দেহখানি তুলে ধরো , তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো’। মাটির প্রদীপ মানবদেহের প্রতীক ; বৃষ্টির জল আর মাটি দিয়ে তৈরি হয় মানুষের দেহ , আর দেবলোকের আগুনে প্রাণের প্রদীপ জ্বেলে মানুষ পৃথিবীতে আসে। মানুষের দেহ এই পৃথিবীর , কিন্তু প্রাণের শিখাটি দেবলোকের। এই পার্থিব দেহ ও ঐশী শিখার সম্মিলনে মানুষ সৃষ্টি হয়। প্রতিটি মানুষ যেন এক-একটি মাটির প্রদীপ — নশ্বর কাদামাটির আধারে অবিনশ্বর আগুনের চৈতন্যশিখা। এই চৈতন্যশিখাকে কেউ বলেন চৈতন্য , কেউ বলেন আত্মা , বাউল সাধকরা বলেন ‘অধর মানুষ’। জাতি , ধর্ম , বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল মানুষের দেহে প্রদীপ্ত প্রাণের একই চৈতন্যশিখা

গানের ভিতর দিয়ে

Image
এই বিশ্বজগৎ এক বিশাল বাদ্যযন্ত্র। এমনটিই মনে করতেন খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকের গ্রীক গণিতবিদ , দার্শনিক ও সংগীততাত্ত্বিক পিথাগোরাস। আর এই বাদ্যযন্ত্র থেকে যে পবিত্র সংগীত সৃষ্টি হয় তাকে বলতেন ‘ মিউজিক অব দ্য স্ফেয়ার ’, বা মণ্ডলা-সংগীত। পিথাগোরাসের কল্পনায় এই বাদ্যযন্ত্র ছিল হার্পজাতীয় তারবাদ্য। যেখানে ‘ স্ট্রিং ’ বা তারে কম্পন তুলে সুর সৃষ্টি করা হত।    একই ধরণের কথা বলেন স্ট্রিং-তত্ত্বের অনুসারী পদার্থবিজ্ঞানীরা। তাঁদের দাবি , এই বিশ্বজগৎ হচ্ছে কম্পমান তারের সিম্ফনি বা ঐকতান-সংগীত। স্ট্রিং-তত্ত্ব হচ্ছে বিশ্বজগৎ সৃষ্টির আধুনিকতম তত্ত্ব। এই তত্ত্বের মূল ধারণা — বিশ্বজগতের সমস্ত বস্তু ও শক্তি এক ধরণের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ‘ স্ট্রিং ’ বা তার দিয়ে গঠিত। সামবেদ-এর সামবিধান ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে , সমস্ত জগৎ সাত সুরের সংগীত প্রবাহে বিধৃত। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব-বীণার কথা বলেছেন , যে বীণার ঝংকারে অনন্ত আকাশের সমস্ত নক্ষত্রলোক ঝংকৃত হয়ে অপূর্ব ‘ নৈঃশব্দ্য-সংগীত ’- এ গাঁথা পড়ছে। পারস্যের সুফি মরমী কবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি বলতেন , আমরা এমন এক জায়গায় এসে পড়েছি যেখানে সবকিছুই সংগীত। আকাশ ভরে আছে সুরে সু