সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব
এই বিশ্ব ঈশ্বরের প্রকাশিত রূপ, আর ঈশ্বর — এই বিশ্বের অপ্রকাশিত রূপ। প্রত্যেক
বস্তুর রয়েছে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য রূপ। যা প্রকাশ্য তা সীমা দ্বারা বেষ্টিত,
অর্থাৎ সসীম। আর যা অপ্রকাশ্য তা সীমার অতীত, অর্থাৎ
অসীম।
ঈশ্বর নিরাকার, কিন্তু সৃষ্টির লীলা চরিতার্থ করার জন্য তিনি যে-কোনও
আকার ধারণ করতে পারেন। যখন তিনি কোনও আকার ধারণ করেন, অর্থাৎ
সীমা গ্রহণ করেন, তখন কোনও কিছুর সৃষ্টি হয়। সীমাই সৃষ্টি,
আর 'অসীম' — সকল সৃষ্টির
উৎস। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘The revelation of the infinite in the finite
is the motive of all creation.’ সীমার মধ্যে ‘অসীম’ নিজেকে প্রকাশ
করবে সেটাই সমস্ত সৃষ্টির মূলভাব। সমস্ত সৃষ্টি তাঁরই অভিব্যক্ত রূপ।
সীমা ও অসীম পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও
বিরুদ্ধ নয়; একটি থাকলে আরেকটি থাকবেই। সীমা
ও অসীমের সম্পর্কটি পারস্পরিক—প্রেমের ও আনন্দের। অর্থাৎ, 'সীমা
অসীমের পক্ষে যতখানি, অসীমও সীমার পক্ষে ততখানি; উভয়ের উভয়কে নহিলে নয়'। তাই, অসীমের
আনন্দ সীমার উপর নির্ভরশীল, সীমা না থাকলে অসীমের প্রেম
মিথ্যে হয়ে যেত।
যিনি অসীম, তিনি সীমার দ্বারাই নিজেকে প্রকাশ করেন, সীমাকে সৃষ্টি করেন। সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র, মেঘ, বৃষ্টি, নদী, সমুদ্র, ফুল, ফল, তরু, লতা, পাখি, পতঙ্গ, মানুষ, জীব — এই সবকিছুর আকার বা সীমা সৃষ্টি তাঁরই
সাধনার ফল। সীমার মাঝে অসীম বিস্তার করে, আর সীমা অসীমকে
প্রকাশ করে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, গোলাপ ফুল সম্পূর্ণরূপে
নিজের সীমাকে লাভ করেছে বলেই সেই সীমার দ্বারা সে এক অসীম সৌন্দর্যকে প্রকাশ করতে
পেরেছে। অসীম যিনি, তিনি সীমার মধ্যেই সত্য ও সুন্দর। এই
সীমার মাঝেই অসীমের আনন্দ, প্রেম ও বিস্ময়। রবীন্দ্রনাথের
ভাষায় — 'সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর। আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর'।