Posts

সত্যম শিবম সুন্দরম

Image
ঈশ্বর নিখিলবিশ্বের সর্বোচ্চ বাস্তব সত্তা । এই মূল সত্তা থেকেই জগৎসংসারের সৃষ্টি ও বিকাশ । কিন্তু কী বৈশিষ্ট্য এই বাস্তব সত্তার? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে সংস্কৃত শব্দের ছন্দোবদ্ধ স্তবক ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ দিয়ে । সত্যম অর্থ সত্য । এই সত্য এমন এক ‘পরম বাস্তবতা’ যা ভিন্নজনের কাছে আপাত ভিন্নরূপে দেখা দিলেও এই বাস্তবতার পশ্চাতে রয়েছে একটি ‘পরম সত্তা’ । যে সত্তা সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায় না, কেবল আনন্দ বেদনা দুঃখ প্রভৃতি অনুভূতির মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায় । শিবম অর্থ শিব । শিব মানে শুভ — যা কিছু মঙ্গলময় ও কল্যাণময় এই বিশ্বে । রবীন্দ্রনাথের ভাষায় — ‘শিবং হচ্ছে মানবসমাজের মধ্যে সেই সামঞ্জস্য যা নিয়তই কল্যানের মধ্যে বিকাশ লাভ করছে’ । সুন্দরম হচ্ছে ‘ সত্য ’ থেকে বেরিয়ে আসা দীপ্তি যা সকল কিছুকে  সৌন্দর্যমন্ডিত করে ।  সূর্যের কিরণ যেমন চাঁদের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে চাঁদকে সুন্দর করে । প্রকৃতপক্ষে , সৌন্দর্য মানেই প্রতিফলিত আলোর মহিমা । প্রকৃতিতে যা কিছু সুন্দর তা সেই পরম জ্যোতির্ময় — পরম ‘ সুন্দরম ’- এর প্রতিফলন মাত্র । তাই , সুন্দরের আরাধনা আর ‘ সত্যম-সুন্দরম ’- এর আরাধনা সমার্থক

তেল মাহাত্ম্য

তেল শব্দটি এসেছে তিল থেকে । তিল থেকে উৎপন্ন বলে এর নাম হয় তৈল বা তেল । প্রাচীনকালে , বাংলাদেশে রান্নার তেল হিসাবে প্রধানত তিলের তেল ব্যবহৃত হত । কালক্রমে , সরিষা নারকেল প্রভৃতির নির্যাস রান্নার তেল হিসাবে জনপ্রিয় হয় । শুধু রান্নায় নয় , তেলের ব্যবহার আরও ব্যপক । শিক্ষাবিদ গবেষক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ( ১৮৫৩ - ১৯৩১ ) বলেছেন — ‘ তৈল নহিলে জগতের কোন কাজ সিদ্ধ হয় না । তৈল নহিলে কল চলে না , প্রদীপ জ্বলে না , ব্যঞ্জন সুস্বাদু হয় না , চেহারা খোলে না । ’ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আরও বলেছেন  — ‘ এক তেলে চাকা ঘোরে ,  আর - তেলে মন ফেরে । ’   অর্থাৎ , তেল রূপক অর্থেও   ব্যবহৃত হয় ।   মানুষ পারস্পরিক সম্পর্ক মসৃণ রাখতে  ‘ তেল ’  ব্যবহার করে ।   এ ধরণের  ‘ তেল ’- কে বলা যেতে পারে  ‘ সামাজিক তেল ’ । সংস্কৃত সাহিত্যে তেলের আরেক নাম স্নেহ । পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন — ‘ বাস্তবিকও স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ । আমি তোমায় স্নেহ করি , তুমি আমায় স্নেহ কর , অর্থাৎ , আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি । স্নেহ কি ? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠান্ডা করে , তাহার নাম স্নেহ । তৈলের ন্যায় ঠান্ডা করিতে আর কিসে পারে ?’ ঘরে - বাই

সিনক্রোনিসিটি — অর্থবহ সমাপতন

প্রতিদিন কত ঘটনাই না ঘটে এই জগতে । কিছু ঘটনা আছে যেগুলো কার্যকারণ সম্পর্কে বাঁধা , অর্থাৎ একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনার কারণ । যেমন , বাতাসে নির্দিষ্ট পরিমান তাপ সঞ্চিত হলে সমুদ্রপৃষ্ঠের জল বাস্পে পরিনত হয় । আবার কিছু ঘটনা আছে যেগুলো পরস্পরের সঙ্গে কার্যকারণ নিয়মে সম্পর্কিত নয় , অকস্মাৎ একই সময়ে ঘটে মাত্র । এগুলোকে বলা হয় সমাপতনিক বা কাকতালীয় ঘটনা । কাকতালীয় ঘটনা কার্যকারণ নিয়ম কিংবা সম্ভাবনা তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না । বিস্ময়কর কাকতালীয় ঘটনা প্রায়শই ঘটে আমাদের জীবনে । আপনি হয়তো কারও কথা খুব ভাবছেন , হঠাৎ তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল পার্কে কিংবা শপিং মলে । এ কি শুধুই কোইনসিডেন্স বা সমাপতন ? হাত থেকে পড়ে কাচের গ্লাস ভেঙে গেলে , মায়ের মন শংকিত হয় — সন্তানের কোনও অমঙ্গল হল না তো । অনেক সময় মায়ের আশংকা সত্য হয় । ‘ গ্লাস ভেঙে যাওয়া ’ এবং ‘ সন্তানের অমঙ্গল হওয়া ’ — ঘটনা দুটি সমাপতনিক , অকস্মাৎ একই সময়ে সংঘটিত হয় মাত্র , একটি অন্যটির কারণ নয় । কিন্তু কী এক গোপন বার্তা যেন বলে যায় আভাসে । সুইস মনশ্চিকিৎসক ও মনঃসমীক্ষক কার্ল গুস্তাভ জুং ( ১৮৭৫ - ১৯৬১ ) মনে করতেন , আমাদের জীবনে অহরহ ঘটে

মেঘ বৃষ্টি তুষার

Image
জলকণা দিয়ে তৈরি হয় মেঘ । মেঘেরা দলে দলে আকাশতলে ভেসে চলে । চলার পথে কোথাও ঝরায় বৃষ্টি , কোথাও বা তুষার । ঈশ্বর যখন ধরিত্রীকে ‘ কলুষমুক্ত ’ করতে চান , শান্তিবারি দিয়ে আশীর্বাদ করতে চান , তখন মেঘ থেকে বর্ষিত হয় বৃষ্টি কিংবা তুষার । বৃষ্টিপাতের সময় মেঘ - নিংড়ানো জল নেমে আসে — ফোঁটায় ফোঁটায় । তুষারপাতের সময় মেঘ নিজেই নেমে আসে — ছোট ছোট টুকরোয় বিভক্ত হয়ে । ঝরে - পড়া মেঘের টুকরোকে বলা হয় স্নোফ্ল্যাক্স বা তুষারফলক — পাখির পালকের মতো হালকা , ষড়ভুজাকার তুষারকণা । বৃষ্টি পড়ে সশব্দে , ঝমঝমিয়ে । জলকলরবে মুখর বৃষ্টিপাত । তুষার নামে নিঃশব্দে , ধীরগতিতে । মৌনতায় মুখর তুষারপাত । তুষারপাতের সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ করে ।   তুষার নিজে সুন্দর ,  যাকে আবৃত করে তাকেও সুন্দর করে ।   তুষারপাতের দৃশ্য অবলোকন মানুষকে নৈঃশব্দ্যের ভাষা অনুধাবনে অনুপ্রাণিত করে । নৈঃশব্দ্যের ভাষা বুঝতে না পারলে মানুষের মুক্তি হয় না । পারস্যের সুফি সাধক মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি বলেছেন — ‘Silence is the language of god, all else is poor translation.’ নৈঃশব্দ্য এমন একটি ভাষা , যে ভাষায় ঈশ্বর কথা বলেন , আর অন্য সবকিছু দুর্বল

রাসলীলা মাহাত্ম্য

Image
‘ আয় তবে সহচরী , হাতে হাতে ধরি ধরি , নাচিবি ঘিরি ঘিরি , গাহিবি গান ’ — এমনই এক আহ্বান ধ্বনিত হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির সুরে কোনও এক কার্তিকী পূর্ণিমায় , সহস্র বর্ষ আগে । মোহন বাঁশির ডাকে সারা দিয়ে গোপনারীরা ছুটে গিয়েছিলেন বৃন্দাবনের অরণ্যে । সেদিন বৃন্দাবনের সেই শারদ রাত , সেই মায়াবী চাঁদ , সেই জ্যোৎস্নাপ্লাবিত অরণ্য — সে সব কিছুই ছিল এক অলৌকিক মায়ায় আচ্ছন্ন , এক দিব্য আলোয় স্নাত । এমন পরিবেশে গোপী - পরিবেষ্টিত শ্রীকৃ ষ্ণ  শারদ-পূর্ণিমা - রাত্রির  স ম্মান রক্ষা করলেন । তিনি পূর্ণ চাঁদের অলৌকিক জ্যোৎস্নায় গোপীদের সঙ্গে রাসনৃত্যে প্রবৃত্ত হলেন । সেই সময় পীতাম্বর শ্রীকৃষ্ণ নিজের অনেকগুলো প্রতিরূপ সৃষ্টি করলেন । রাসমন্ডলে যতজন গোপী ছিলেন , শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে তত সংখ্যক করে , সেই গোপীদের প্রত্যেকের সঙ্গে নৃত্য করলে ন ।  কেউ ভাবতে পারলেন না, শ্রীকৃষ্ণ তার সঙ্গে নেই । রাসলীলায় এক কৃষ্ণ দেখা দিলেন বহু কৃষ্ণ রূপে । এই ব্যাপারটার একটা রূপক অর্থ আছে । আকাশে চাঁদ একটাই । কিন্তু বহু জলাশয়ে তা প্রতিবিম্বিত হতে পারে । তেমনই , ব্রহ্মান্ডে শ্রীকৃষ্ণ একজনই , কিন্তু তিনি প্রতিবিম্বিত হতে পারেন অসং

কালী — কালের দেবী

Image
কার্তিক মাসের অমানিশি । অলৌকিক সুন্দর অন্ধকারে আচ্ছন্ন চরাচর । নৈঃশব্দ্যের সুরে বিভোর আকাশের নক্ষত্ররাজি । এমনি সময় অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত হয় জ্যোতির্ময়ী আলো । পৃথিবীর মানুষ ধ্যানমগ্ন হয় মুক্তকেশী ত্রিনয়নী দেবী কালীর সাধনায় । কিন্তু কে এই কালী? কী তাৎপর্য কালীসাধনার ? কালী এক রহস্যময়ী দেবী । তিনি অন্য দেবীদের নিরিখে একেবারেই স্বতন্ত্র । একদিকে খড়্গ, নরমুন্ড, রক্ত, অন্যদিকে বরাভয় । এইরকম বৈপরীত্যের সমাহার অন্য কোনও দেবীর বেলায় দেখা যায় না । কবিগুরুর একটি গানের কথায় কালী-রূপের এই বৈপরীত্য সুন্দরভাবে উঠে এসেছে — ‘ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ, দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ’ । কালী অনন্যা, অপরূপ রূপের অধিকারিণী । তাঁর মুক্তকেশের পুঞ্জ মেঘে লুকায় অশনি । তাঁকে দেখে দেখে আঁখি না ফিরে ।   কালী শব্দের উৎপত্তি ‘কাল’ থেকে । মহানির্বাণ তন্ত্রের চতুর্থ উল্লাসে আছে — যিনি কালকে কলন অর্থাৎ গ্রাস করেন তিনি কালী । কালী হচ্ছেন কালের অধিষ্ঠাত্রী দেবী । তিনি ‘ কাল ’ নিয়ন্ত্রণ করেন । সর্বজীবকে নিয়ন্ত্রণ করে যে কাল, সেই কালকে নিয়ন্ত্রণ করেন কালী । বস্তুত স

বিপাসনা — দুঃখবোধ থেকে মুক্তির উপায়

মৃদঙ্গের তাল কেটে যাওয়ার অপরাধে সুরসভার গীতনায়ক সৌরসেন এবং তার প্রেয়সী মধুশ্রীকে স্বর্গলোক থেকে বহিস্কার করলেন ইন্দ্রদেব । বললেন , ‘ যাও মর্তে , সেখানে দুঃখ পাবে , দুঃখ দেবে । সেই দুঃখে ছন্দঃপাতন অপরাধের ক্ষয় । ’ পৃথিবীর মানুষ আজও তাই বহন করে চলেছে দুঃখের ভার । মানুষ দুঃখের ভার নামিয়ে সুখ লাভের চেষ্টা করে প্রতিনিয়ত , কিন্তু কদাচিত তাতে সফল হয় । সময়ে সময়ে জীবন মনে হয় বিরক্তিকর , অতৃপ্তিকর । কখনও কখনও মনে হয় — জীবন দুঃখময় । যদিও বা কোনও মুহূর্তে নিজেকে দুঃখহীন মনে হয় , পরক্ষণেই মনে পড়ে এমন কোনও সময়ের কথা যা একদিন দুঃখ দিয়েছিল , এবং ভবিষ্যতে আবার দুঃখ দিতে পারে । কখনও কখনও মানুষ ব্যক্তিগত দুঃখবোধ শুধু নিজের মধ্যে সীমিত রাখতে পারে না , অন্যদের সঙ্গেও শেয়ার করে । তখন অন্যদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয় দুঃখবোধ । এই ভাবে ব্যক্তিগত দুঃখবোধ পরিণত হয় সামাজিক দুঃখবোধে । দুঃখ মানুষের জীবনের মূল সমস্যা । মানুষ যা চায় তা ঘটে না , যা চায় না তা ঘটে । কেন এমন হয় তা মানুষের অজানা ।  আড়াই হাজার বছর আগে একজন রাজবংশীয় পুরুষ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি মানুষের দুঃখকষ্ট নিয়ে অনুসন্ধান করবেন । তাঁর নাম সিদ