হিন্দু, হিন্দুইজম ও হিন্দুত্ব
হিন্দু কি একটি মতবাদ? হিন্দু শব্দের প্রকৃত ব্যাখ্যা কী? হিন্দু ও হিন্দুইজম কি সমার্থক? সম্প্রতি, এই সব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করা হয়েছে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড হিন্দু
কংগ্রেস’-এর বার্ষিক সম্মেলনে৷ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত তিন দিন
(২৪-২৬ নভেম্বর, ২০২৩) ব্যাপী সেই সম্মেলনে অংশ গ্রহণ
করেছিলেন ৬১টি দেশ থেকে ২,০০০-এরও বেশী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব,
সংগঠন ও প্রতিনিধি৷
এই বিশ্ব হিন্দু সম্মেলনে একটি
গুরুত্বপূর্ণ ডিক্লারেশন বা ঘোষণাপত্র গৃহিত হয় যেখানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে
‘হিন্দুইজম’ (Hinduism) শব্দকে সম্পূর্ণ বাতিল
ঘোষণা করা হয়৷ এবং ‘হিন্দুইজম’-এর পরিবর্তে ‘হিন্দুত্ব’ (Hindutva) ব্যবহার করার কথা বলা হয়৷ এখন থেকে ‘হিন্দুত্ব’ হবে বিশ্বের প্রায় ১০০টি
দেশে বসবাসরত ১২০ কোটির বেশি মানুষের জীবন দর্শনের নাম৷ যে জীবন দর্শন সকলের
সংস্থান ও সহাবস্থানকে দৃঢ় ও সুনিশ্চিত করে৷
‘হিন্দুত্ব’ নতুন কোনও বিষয় নয়৷ যখন
থেকে হিন্দু জাতির উদ্ভব হয়েছে, তখন থেকে ‘হিন্দুত্ব’ বিদ্যমান আছে৷ যাকে হিন্দু বলা হয় তারই বৈশিষ্ট্যগত
ভাব হল হিন্দুত্ব৷ যেমন মানুষের মনুষ্যত্ব, দেবতার দেবত্ব৷
যেমন প্রত্যেক ব্যক্তির থাকে বিশেষ ব্যক্তিত্ব, তেমনি
হিন্দুর অনন্য ব্যক্তিত্ব হল হিন্দুত্ব৷ হিন্দুত্বকে ‘হিন্দুনেস’ (Hinduness)
বলা যেতে পারে, কিন্তু ‘হিন্দুইজম’ কখনোই নয়৷
হিন্দুইজম, সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ বোঝায়৷ ‘ইজম’ প্রত্যয় যুক্ত হওয়ার
কারণে হিন্দুধর্ম হয়ে দাঁড়ায় একটি মতবাদ বিশেষ৷ যেমন মার্কসিজম, সোশ্যালিজম, কমিউনিজম, ম্যাটেরিয়ালিজম,
কাপিটালিজম ইত্যাদি৷ আসলে হিন্দুধর্ম কোনও মতবাদ নয়৷ হিন্দুধর্ম
একটি জীবনধারার নাম। যা সতত গতিশীল। যার গন্তব্য
পূর্ণতার দিকে৷
‘হিন্দুধর্ম’ শব্দবন্ধে ‘হিন্দু’ কোনও
বিশেষ অর্থে সীমিত নয়৷ হিন্দু বলতে যা-কিছু শাশ্বত, চিরকালীন সব-কিছুই বোঝায়৷ আর ‘ধর্ম’ শব্দটির মানে, ‘যা
ধারণ করে, টিকিয়ে রাখে’৷ এইভাবে, ‘হিন্দুধর্ম’
সেই সমস্ত কিছুকে বোঝায় যা চিরন্তনভাবে সমস্ত কিছুর (ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, প্রকৃতি)
অবলম্বন হয়৷
‘হিন্দুত্ব’ বুঝতে
হলে ‘হিন্দু’ শব্দের উৎসগত দিকটি ভাল
করে বুঝতে হবে৷ উল্লেখ্য, এখনকার হিন্দুদের পূর্বপুরুষরা
নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিত না। হিন্দুদের বেদ, রামায়ণ,
ভগবদগীতা প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থেও হিন্দু শব্দের উল্লেখ নেই। হিন্দু
শব্দটির প্রথম উল্লেখ দেখা যায় আর্যদের ইরানীয় শাখার প্রাচীন গ্রন্থ আবেস্তায়।
সেখানে সিন্ধু সভ্যতার দেশকে হপ্তহিন্দু (সপ্তসিন্ধুর অপভ্রংশ রূপ) বলা হয়েছে৷
পরবর্তীতে পারস্যের রাজা ডেরিয়াস এই অঞ্চলের নাম দেন ‘হিন্দু’৷ সেই সময় হিন্দু
কোনও বিশেষ জাতি বা ধর্মালম্বী মানুষকে নির্দেশ করত না৷ হিন্দু ছিল ভৌগলিক অঞ্চলের
নাম৷
বিখ্যাত চিন দেশীয় পরিব্রাজক ই-সিং
খৃস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে লিখে
গেছেন যে মধ্য এশিয়ার লোকেরা ভারতবর্ষকে হিন্দু (সিন-টু) বলত এবং এ নামটি
সাধারণভাবে প্রচলিত নয়।
প্রায় ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে
মধ্যপ্রাচ্যের হানাদার সৈন্যবাহিনী সিন্ধুনদের ওপারের অঞ্চলকে ‘হিন্দুস্তান’ আর
সেখানকার অধিবাসীদের ‘হিন্দু’ নামে অভিহিত করে। পরবর্তী কালে ইউরোপীয়রাও এ দেশের অধিবাসীদের
হিন্দু নামে আখ্যায়িত করে৷ সেই সময়ের যথার্থ বর্ণনা দিয়েছেন বিশিষ্ট পণ্ডিত, সমাজবিদ হারজত ওবেরয় (Harjot Oberoi) — ‘At
one stage, the word Hindu as an ethno-geographic category came to englobe all
those who lived in India, without ethnic distinction’. এক পর্যায়ে,
জাতিগত-ভৌগোলিক শ্রেণি
হিসাবে হিন্দু শব্দটি ভারতবর্ষে বসবাসকারী সকল মানুষকে, জাতিগত ভেদাভেদ ছাড়াই,
অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, সুফি কবি আমির খসরু (১২৫৩-১৩২৫) বলতেন — আমি হিন্দু। কারণ আমি ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ
করেছি।
সুতরাং
দেখা যাচ্ছে, ‘হিন্দু’
মূলত একটি ধর্মনিরপেক্ষ শব্দ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভারতীয় উপমহাদেশে
বসবাসকারী সব মানুষকে হিন্দু বলা হত। পরবর্তীতে, মুসলিম শাসকদের অধীনে ‘হিন্দু’ শব্দটির
ধর্মীয় অর্থে ব্যবহার শুরু হয়। এবং কালক্রমে সেই অর্থের মধ্যে শব্দটি আটকা পড়ে
যায়।
সমস্যা
হচ্ছে, হিন্দুধর্মকে একটি ধর্ম
হিসাবে আখ্যায়িত করা কঠিন। কারণ, প্রচলিত অর্থে যে-সমস্ত
বৈশিষ্ট্যের কারণে একটি ধর্মকে ধর্ম বলা হয় তা হিন্দুধর্মের ক্ষেত্রে বিশিষ্টরূপে
চিহ্নিত করা যায় না। হিন্দু ধর্ম কোনও একজন ব্যক্তির মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে
উঠেনি। হিন্দুধর্মের নেই কোনও একক বিশ্বাস পদ্ধতি। নেই কোনও একক ধর্মগুরু বা ধর্ম
প্রণেতা। নেই কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব। কিন্তু তা সত্ত্বেও কী প্রগাঢ় এর প্রাণশক্তি এবং
টিকে থাকার ক্ষমতা।
ভারতের
বিভিন্ন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মতাদর্শ নিয়েই জন্ম নিয়েছে হিন্দুধর্ম। এই ধর্ম খুবই স্বাভাবিক
এবং দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইদানিং বলা হচ্ছে, হিন্দু পরিচয়টা কোনও ধর্ম বা সম্প্রদায় বিশেষ নয়। এটা একটা সাংস্কৃতিক
শব্দ। যারা ভারতে জন্মেছেন তারা সবাই হিন্দু। নানা বৈচিত্র্য সত্ত্বেও হিন্দু সংস্কৃতি অখণ্ড।
পশ্চিমা
পণ্ডিত এবং খ্রিস্টান মিশনারিরা ভারতবর্ষে আসার পর লক্ষ করলেন, হিন্দুদের ধর্মের কোনও
একক নাম নেই। হিন্দুরা শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত,
তান্ত্রিক ইত্যাদি বহু ধর্মীয় সম্প্রদায়ে বিভক্ত এবং প্রত্যেক
সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস, বিশ্বদর্শন,
আচার, উপাসনা পদ্ধতি। এই সম্প্রদায়গুলির ভিন্ন
ভিন্ন ধর্মের জন্য একটি সাধারণ নাম ‘হিন্দুইজম’ প্রবর্তন করেন ব্রিটিশ লেখকরা।
উল্লেখ্য, ‘হিন্দুইজম’ শব্দটি প্রথম প্রবর্তন ও প্রচলন করেন
ব্রিটিশ পন্ডিত স্যার মনিয়ার উইলিয়ামস তার জনপ্রিয় পুস্তিকা ‘হিন্দুইজম’-এর
মাধ্যমে৷ পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে, প্রকাশক
‘সোসাইটি ফর প্রমোটিং ক্রিশ্চিয়ান নলেজ’৷ আজ অনেকে মনে করেন, ‘হিন্দুইজম’ পরিভাষাটির উদ্ভাবন ছিল বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অসৎ৷ কারণ এই
শব্দটি গত ১৫০ বছর ধরে হিন্দুধর্ম বিরোধী প্রচারণার উৎসবীজ হিসাবে কাজ করেছে৷
আজ অধিকাংশ হিন্দু পণ্ডিত মনে করেন, ‘হিন্দুইজম’ শব্দটি হিন্দুদের ধর্ম সম্বন্ধে ভুল
বার্তা দিচ্ছে। হিন্দুদের ধর্ম যেন একটি ‘ইজম’ — একটি মতবাদ। এই সব কারণে বিশ্ব
হিন্দু সম্মেলনে ‘হিন্দুইজম’-এর পরিবর্তে ‘হিন্দুত্ব’ (Hindutva) ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে৷ হিন্দুত্ব জীবন সম্পর্কিত আর হিন্দুইজম হল মতবাদ
বা বিশ্বাস সম্পর্কিত৷ তাই যতদিন হিন্দু থাকবে ততদিন হিন্দুত্ব থাকবে৷
হিন্দুর সামগ্রিক জীবনের কিছু অংশ
যেমন আচরণ, বিশ্বাস, উপাসনা
পদ্ধতিকে হিন্দুত্ব বলা ভুল হবে৷ একজন নাস্তিককেও (যেমন ঋষি চার্বাক) বলা যাবে না
যে তিনি হিন্দু নন৷ হিন্দুত্ব জনগণের সামগ্রিক সংস্কৃতি এবং নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত।
তারা হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি ইত্যাদি যাই হোক না কেন। হিন্দুত্ব
তার সব সন্তানকে আঁকড়ে ধরে থাকে৷
হিন্দুত্ব শব্দের অর্থের সারসংক্ষেপ একটি ধর্মের সংকীর্ণ গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তা ভারতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ ভারতীয় উপমহাদেশের জীবন পদ্ধতির সঙ্গে ‘হিন্দুত্ব’ সংযুক্ত৷ দ্বন্দ্বভাব, শত্রুভাব, পরধর্ম অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে ‘হিন্দুত্বের’ কোনও সম্পর্ক নেই৷