রাসলীলা মাহাত্ম্য
‘আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি,
নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান’ — এমনই এক আহ্বান ধ্বনিত হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির সুরে কোনও এক কার্তিকী
পূর্ণিমায়, সহস্র বর্ষ আগে। মোহন বাঁশির
ডাকে সারা দিয়ে গোপনারীরা ছুটে গিয়েছিলেন বৃন্দাবনের অরণ্যে।
সেদিন বৃন্দাবনের সেই শারদ রাত, সেই মায়াবী চাঁদ, সেই জ্যোৎস্নাপ্লাবিত অরণ্য —
সে সব কিছুই ছিল এক অলৌকিক মায়ায় আচ্ছন্ন, এক
দিব্য আলোয় স্নাত। এমন
পরিবেশে গোপী-পরিবেষ্টিত শ্রীকৃষ্ণ শারদ-পূর্ণিমা-রাত্রির সম্মান রক্ষা করলেন। তিনি
পূর্ণ চাঁদের অলৌকিক জ্যোৎস্নায় গোপীদের সঙ্গে রাসনৃত্যে প্রবৃত্ত হলেন। সেই সময় পীতাম্বর শ্রীকৃষ্ণ নিজের অনেকগুলো প্রতিরূপ
সৃষ্টি করলেন।
রাসমন্ডলে যতজন গোপী ছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে তত সংখ্যক করে,
সেই গোপীদের প্রত্যেকের সঙ্গে নৃত্য করলেন। কেউ ভাবতে পারলেন না, শ্রীকৃষ্ণ তার সঙ্গে নেই।
রাসলীলায় এক কৃষ্ণ দেখা দিলেন বহু কৃষ্ণ রূপে। এই ব্যাপারটার
একটা রূপক অর্থ আছে। আকাশে চাঁদ
একটাই। কিন্তু বহু জলাশয়ে তা প্রতিবিম্বিত হতে পারে। তেমনই, ব্রহ্মান্ডে
শ্রীকৃষ্ণ একজনই, কিন্তু তিনি প্রতিবিম্বিত হতে পারেন অসংখ্য
ভক্তের অন্তরে। এক পরমেশ্বর
বিরাজ করেন বহু ভক্তের হৃদয়ে — এটা রাসলীলার একটা আধ্যাত্মিক তাৎপর্য।
প্রকৃতপক্ষে, রাসলীলা কোনও ঐতিহাসিক ঘটনা নয়; রাসলীলা হচ্ছে একটা রূপক। বলা যেতে পারে, জগতের প্রধানতম আধ্যাত্মিক রূপক। এই রূপকের মাধ্যমে পরমসত্তার সঙ্গে
ব্যক্তিসত্তার সম্পর্ককে বোঝানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, —
‘raas leela is an external expression of divine leela which takes place in the
heart of each and every individual, between the finite and the universal soul.’
অর্থাৎ, পরমাত্মার সঙ্গে অন্তরাত্মার সংসর্গের
যে দিব্য লীলা চলে প্রত্যেক মানুষের অন্তরে, তারই প্রকাশ ঘটে
রাসলীলায়।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ
রচিত চৈতন্যচরিতামৃতে চৈতন্য মহাপ্রভুর বয়ানে বলা হয়েছে,
‘অন্যের হৃদয় মন আমার মন বৃন্দাবন
মনে
বনে এক করি জানি।’
অর্থাৎ, মন এবং বৃন্দাবনের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। বলাবাহুল্য, প্রকৃত রাসলীলা সংঘটিত হয় বাহিরে নয়, ভক্তের অন্তরে;
ভৌগোলিক বৃন্দাবনে নয়, মনের বৃন্দাবনে। অন্য কথায়, মানুষের দেহের অভ্যন্তরেই ঘটে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা। রাসলীলা তাই দেহতত্ত্বের রূপকও বটে।
রাসলীলার আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য অনুধাবন মানুষকে দিতে পারে অনাবিল
আনন্দ, সেই সঙ্গে দিব্য অনুভূতি আর দিব্য প্রেমের আস্বাদ। আর এ-সবই হচ্ছে রাসলীলার প্রকৃত রস।▣
✍অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা