কালী — কালের দেবী
কার্তিক মাসের অমানিশি। অলৌকিক সুন্দর
অন্ধকারে আচ্ছন্ন চরাচর। নৈঃশব্দ্যের সুরে বিভোর আকাশের নক্ষত্ররাজি। এমনি সময়
অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত হয় জ্যোতির্ময়ী আলো। পৃথিবীর মানুষ ধ্যানমগ্ন হয় মুক্তকেশী ত্রিনয়নী দেবী কালীর সাধনায়। কিন্তু কে এই কালী? কী তাৎপর্য কালীসাধনার?
কালী এক রহস্যময়ী দেবী। তিনি অন্য দেবীদের নিরিখে একেবারেই স্বতন্ত্র। একদিকে খড়্গ, নরমুন্ড, রক্ত, অন্যদিকে বরাভয়। এইরকম বৈপরীত্যের সমাহার অন্য কোনও দেবীর বেলায় দেখা যায় না। কবিগুরুর একটি গানের কথায় কালী-রূপের এই বৈপরীত্য সুন্দরভাবে উঠে এসেছে — ‘ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ, দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ’। কালী অনন্যা, অপরূপ রূপের অধিকারিণী। তাঁর মুক্তকেশের পুঞ্জ মেঘে লুকায় অশনি। তাঁকে দেখে দেখে আঁখি না ফিরে।
কালী শব্দের উৎপত্তি ‘কাল’ থেকে। মহানির্বাণ তন্ত্রের চতুর্থ উল্লাসে আছে — যিনি কালকে কলন অর্থাৎ
গ্রাস করেন তিনি কালী। কালী হচ্ছেন কালের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তিনি ‘কাল’ নিয়ন্ত্রণ করেন। সর্বজীবকে নিয়ন্ত্রণ করে যে কাল, সেই
কালকে নিয়ন্ত্রণ করেন কালী। বস্তুত সব
কিছুই কালের অধীন। এমনকী দেবাদিদেব মহাদেবও কালের অধীন। কালীর পদতলে মহাদেবের শুয়ে থাকার তাৎপর্য সেটাই।
সব কিছুই কালীর অধীন। কিন্তু কালী কোনও কিছুর অধীন নন, তাই তিনি মুক্তকেশী। কালী দেশ-কালের সীমায় আবদ্ধ নন, তিনি
অনন্তের প্রতীক। তাই তিনি দিগবসনা।
‘কাল’ শব্দটির এক অর্থ ‘সময়’। সময় মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। সময়ের কারণে মানুষ বৃদ্ধ হয়। সময়ের কারণে
মানুষ একদিন কালগ্রাসে পতিত হয় এবং মৃত্যু বরণ করে। আমরা কথাচ্ছলে প্রায়শই বলে থাকি — ‘কিলিং টাইম’। কিন্তু আমরা
জানি না — আসলে ‘কাল’ আমাদেরকে নীরবে বধ করে চলেছে।
‘কাল’ শব্দটির আর এক অর্থ ‘মৃত্যু’। তাই কালী মৃত্যুরও দেবী বটে। মানুষের মৃত্যু কালের হাতে। আর সেটা বোঝাতেই কালীর চার হাতের এক হাতে খড়্গ আর এক হাতে নরমুন্ড এবং
গলায় নরমুন্ডমালা। আমরা সবাই একদিন কালীর মুন্ডমালার অংশ হব। কালী এক দিকে মৃত্যুর দেবী হলেও অন্য দিকে অমরত্বের দেবী। তাঁর অন্য দুহাতের একটিতে অভয়মুদ্রা আর একটিতে বরমুদ্রা। এই মুদ্রা প্রদর্শনের মাধ্যমে দেবী মানুষকে আশ্বাস দেন মৃত্যুকে ভয়
না পেয়ে কালীর শরণাপন্ন হলে কালহীন অমরত্ব লাভ করা সম্ভব।
কালী একই সঙ্গে সময়ের দেবী এবং মৃত্যুর দেবী। সংস্কৃত ভাষায় ‘সময়’
ও ‘মৃত্যু’ উভয়ের জন্য
রয়েছে একটি শব্দ — ‘কাল’। সময়কে বলা হয় ‘কাল’, আবার মৃতুকেও বলা হয় ‘কাল’। ‘সময়’ ও ‘মৃত্যু’ যেন এক রহস্যময় সূত্রে বাঁধা দুটি সমার্থক শব্দ। এটাই সংস্কৃত ভাষার আধ্যাত্মিক
সৌন্দর্য। সম্ভবত গোটা বিশ্বে একমাত্র সংস্কৃত ভাষাতেই একই শব্দের অর্থ সময় ও
মৃত্যু।
কালী — কালের দেবী। কিন্তু তিনি
কালের নাগালের বাইরে। তাঁর নিবাস
অনন্ত কালে। কালের দেবী হয়ে
তিনি কালের শক্তিকে সংহার করেন এবং চিরন্তনকে প্রতিষ্ঠা করেন। সুতরাং, কালীসাধনার তাৎপর্য হচ্ছে — কালের
কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে অমরত্ব লাভের সাধনা।
পরিশেষে কার্তিক অমানিশিতে প্রার্থনা এই —
হে আকাশ-বসনা দেবী, তোমার দীপ্তিমান ত্রিনয়নের আলোয় প্রজ্বলিত করো আমাদের হৃদয়, যেন তা প্রদীপের ন্যায় উদ্ভাসিত হয় দীপান্বিতায়।
হে প্রিয়তমা কালের দেবী, আমাদেরকে কালের প্রভাব থেকে মুক্ত করে কালহীন অনন্ত জীবনের পথে পরিচালিত করো। ▣