স্বল্পদৈর্ঘ্য পথ — অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির আলোকে

কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া গ্রামে সকাল বেলায় এক কৃষক মাঠে কাজ করছিল। একটি গাড়ি এসে ধান ক্ষেতের পাশে দাঁড়াল। এক ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে এসে কৃষককে জিজ্ঞেস করল আচ্ছা, এখান থেকে সাঁইজীর আখড়া কত দূর?

কৃষক বলল আপনার গাড়িটি যেদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে সোজা চালিয়ে গেলে প্রায় ২৪ হাজার মাইল। আর যদি গাড়িটি ঘুরিয়ে নিয়ে ওই দিকে যান তাহলে মাত্র তিন মাইল।

ভদ্রলোক একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল তার মানে?

কৃষক বলল আপনি যেদিকে যাচ্ছিলেন সেদিকে সোজা চলতে থাকলে একদিন ঠিকই গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন, কারণ পৃথিবী গোলাকার। কিন্তু আপনাকে পৃথিবীর পুরো ঘের (পরিধি) ঘুরে আসতে হবে।

উল্লিখিত গল্পটির আধ্যাত্মিক তাৎপর্য রয়েছে তবে, সবচেয়ে কম দূরত্বের পথ কোনটি, তা জানতে চাওয়া সাধারণ জিজ্ঞাসার ব্যাপার স্কুলে পড়া জ্যামিতি অনুসারে -বিন্দু -বিন্দুর মধ্যে সবচেয়ে কম দূরত্ব হল বিন্দু দু'টির মধ্যে আঁকা একটি সরল রেখা প্রায় দুই হাজার বছর আগে এই জ্যামিতিক সিদ্ধান্তটি প্রণয়ন করেছিলেন গ্রীসের গণিতবিদ ইউক্লিড ইউক্লিড-কে ক্লাসিক্যাল জ্যামিতির প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় পিথাগোরাস-এর জন্মের প্রায় দুশো বছর পর জন্মেছিলেন ইউক্লিড; তাঁর নিবাস কর্মস্থল ছিল মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে সেই সময় পৃথিবীর গোলাকৃতি সম্পর্কে মানুষ অবগত ছিল না তাই ইউক্লিডের জ্যামিতি ছিল সমতল পৃথিবীর ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত

সম্প্রতি, তাও প্রায় দুশত বছর আগে নতুন এক জ্যামিতির কথা বলা হল, যা - ইউক্লিডীয় জ্যামিতি নামে পরিচিত এই জ্যামিতির মতে, ‘সরল রেখা’ একটি ভ্রান্ত ধারণা, এর অস্তিত্ব কেবলই কল্পনায় কারণ একটি সরল রেখা আঁকতে হলে যে সমতল পৃষ্ঠের প্রয়োজন হয় তারই অস্তিত্ব নেই কোথাও পৃথিবী গোলাকার, চাঁদ গোলাকার, আকাশ গোলাকার, গ্রহ-নক্ষত্র গোলাকার এই ব্রহ্মান্ডে কোথাও এতটুকু সমতল ভূমি নেই যেখানে একটি সরল রেখা আঁকা সম্ভব তাই যদি হয় তাহলে সবচেয়ে কম দূরত্বের পথ কোনটি?

সাধারণভাবে মনে হতে পারে, একটি মানচিত্রে দু’টি বিন্দুর মধ্যে সবচেয়ে ছোট পথ হলো ওই বিন্দু দুটির মধ্যবর্তী সরল রেখা কিন্তু পৃথিবী তো আর মানচিত্রের কাগজের মতো চেপ্টা নয়, পৃথিবী গোলাকার তাই ইউক্লিডীয় জ্যামিতির নিয়ম এখানে খাটে না

নাবিক বিমান-চালক মাত্রেই জানেন যে, গোলাকার পৃথিবীর পৃষ্ঠে দুটি বিন্দুর মধ্যে স্বল্পতম দৈর্ঘ্যের পথটি হলো মহাবৃত্তের যে চাপ এদের যোগ ঘটায় সেটি বৃত্তের চাপ (বৃত্তের পরিধির অংশ) বাঁকা, তাই নাবিকদের চার্ট- সবচেয়ে কম দূরত্বের পথটিও বাঁকা মহাবৃত্তের চাপ নির্দেশিত বাঁকা রেখার পথটাকে বলা হয় অর্থোড্রোম, আর বিন্দু দুটির মধ্যবর্তী সরল রেখার পথটিকে বলা হয় লক্সোড্রোম

orthodrome loxodrome
সিডনি-সান্টিয়াগো

ছবিতে সিডনি থেকে সান্টিয়াগো যাওয়ার দুটি পথ দেখানো হয়েছে; একটি, লক্সোড্রোম বা সরল রেখার পথ, অন্যটি, অর্থোড্রোম বা বাঁকা রেখার পথ সাধারণভাবে মনে হতে পারে সরল রেখার পথটির দৈর্ঘ্য বাঁকা রেখার পথটি থেকে কম, কিন্তু বাস্তবে তা ঠিক নয় এখানে সোজা পথটির দৈর্ঘ্য ১২,৮০২ কিলোমিটার, আর বাঁকা পথটির দৈর্ঘ্য ১১,৩৬৩ কিলোমিটার অর্থাৎ সিডনি থেকে সান্টিয়াগো যাওয়ার সবচেয়ে কম দূরত্ব হলো বাঁকা পথটা, সরল রেখাটা নয় একথা ঠিক যে, বাঁকা পথ অনুসরণ করলে ক্রমাগত দিক বদলাতে হবে, কিন্তু ১,৪৩৯ কিলোমিটার ভ্রমণের সময় ইন্ধন সাশ্রয় হবে

লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য থাকে সোজা পথ, থাকে বাঁকা পথ উভয় পথই পৌঁছে দিতে পারে গন্তব্যে কিন্তু সোজা পথে দূরত্ব বেশি বাঁকা পথে দূরত্ব কম, তাই সময় ইন্ধন সাশ্রয় বেশি

‘দুই বিন্দুর মধ্যে স্বল্পতম দূরত্ব হল একটি বাঁকা রেখা’ -ইউক্লিডীয় জ্যামিতির এই সিদ্ধান্তটি জ্যামিতির বাইরেও যেন প্রযোজ্য জ্যামিতির বাইরে, দুই বিন্দুর মধ্যে স্বল্পতম দৈর্ঘ্যের রেখাটি কদাপি সরল হয়ে থাকে। 

অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা 

Popular posts from this blog

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চেনার উপায়

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা — চন্দ্রসূর্যের মিলন ও বিরহ তিথি

তেল মাহাত্ম্য

ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ

রাসলীলা মাহাত্ম্য

আঁধারের রূপ ও বিপন্ন অন্ধকার

আধ্যাত্মিকতা — পাশ্চাত্য ভাবধারার আলোকে

সূর্য উপাসনা

হৃদয়-দর্পনে দেখা