ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ
ঈশ্বরের অবস্থান
নিয়ে দু’টি ভুল ধারণা রয়েছে। প্রথমত, ঈশ্বর ‘সুদূর
আকাশে’ অবস্থান করেন — একটি বড় ভুল। দ্বিতীয়ত, তিনি ‘আমার মধ্যে’ বিরাজমান — যদিও ছোট ভুল, তবুও বিভ্রান্তিকর।
ঈশ্বর আকাশে
অবস্থান করেন
এই ধারণা প্রধানত
একেশ্বরবাদী ধর্মে প্রচলিত। সেখানে
ঈশ্বরকে ব্যক্তি রূপে কল্পনা করা হয়, যেমন শাসক, বিচারক বা প্রতিনিধি প্রেরণকর্তা। এই ব্যক্তি-ঈশ্বর মানুষের বিবাদে পক্ষপাতপূর্ণ হন বলে দাবি করা হয়, এবং তাঁকে পক্ষে দেখিয়ে নিজেদের অবস্থানকে
ন্যায্যতা দেওয়া হয়। এভাবে ন্যায়হীন কাজও বৈধতা পায়।
ঈশ্বর আকাশে
থাকেন, ধারণাটির অন্তর্নিহিত অর্থ হল ঈশ্বর
ও মানুষ আলাদা এবং পৃথক সত্তা। এটি এক
গভীর ভুল ধারণা, যা আধ্যাত্মিকতার
প্রকৃত বোধকে ক্ষুণ্ণ করে। বাস্তবতা
হল, সৃষ্টিজগতের সবকিছুই ঈশ্বরের অংশ। তন্ত্র মতে, ‘যাহা আছে
দেহভান্ডে, তাহাই আছে ব্রহ্মান্ডে’ — অর্থাত্ মানুষ
এবং মহাজগত্ একই উপাদানে নির্মিত। তাই
ঈশ্বর কোনও দূরবর্তী সত্তা নন; সমগ্র
সৃষ্টিতে তিনি অন্তর্ভুক্ত।
ঈশ্বর আমার মধ্যে আছেন
এ ধারণা আংশিক সঠিক। মানুষ ঈশ্বরের
অংশ বলেই নিজেকে আত্মস্থ করার মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভূত হয়। যেহেতু মানুষ
ঈশ্বরেরই অংশ, তাই একে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলা
যায় না। তবে সমস্যাটি তখনই সৃষ্টি হয়, যখন বাইরের জগৎকে ঈশ্বর থেকে পৃথক ভাবা হয়।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকল খানে।’ তাঁর উপলব্ধি হল, যাঁকে আমরা অন্তরে অনুভব করি, তিনি সর্বত্র বিরাজমান।
তাঁর ঈশ্বর কোনও ব্যক্তি নন; তিনি নৈর্ব্যক্তিক সত্তা, যা প্রকৃতিজগতের প্রতিটি কণায় উপস্থিত।
সর্বেশ্বরবাদ ও প্রকৃতি-দর্শন
রবীন্দ্রনাথের দর্শন সর্বেশ্বরবাদ বা
প্যানথিজমের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ,
যার উৎস উপনিষদের
অদ্বৈতবাদে নিহিত। এই মত অনুযায়ী, প্রকৃতিই ঈশ্বর এবং ঈশ্বর প্রকৃতি। বারুখ
স্পিনোজা, উইলিয়াম ব্ল্যাক, আলবার্ট আইনস্টাইন, ও কার্ল সেগানের মতো মনীষীরাও এই মতবাদকে সমর্থন করেছেন।
‘প্রকৃতি’
শব্দের অর্থ ‘পূর্বসৃষ্ট’ (প্রি-ক্রিয়েটেড), যা সব কিছুর পূর্বে সৃষ্ট হয়েছে; প্রকৃতি স্বয়ংসৃষ্ট। প্রকৃতিই
আদি শক্তি, সকল সৃষ্টির মূল। প্রকৃতির মাধ্যমেই বিশ্বজগতের সৃষ্টি ও বিকাশ ঘটে। ঈশ্বর মানে ‘ঐশ্বর্য’। প্রকৃতির
সমস্ত ঐশ্বর্যই ঈশ্বরের বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃতির অফুরন্ত
ঐশ্বর্যের মাধ্যমে ঈশ্বরের সত্তা অনুভূত হয়। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেও
প্রকৃতির সঙ্গে ঈশ্বরের গভীর সংযোগ ফুটে ওঠে। তাঁর
মতে, প্রকৃতির প্রতিটি অংশই ঈশ্বরময় এবং সেখান
থেকেই ঈশ্বরের অনুভব সম্ভব।
রবীন্দ্রনাথ ও
প্রকৃতি
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির প্রতি গভীর প্রেমে মগ্ন ছিলেন। তাঁর মতে, প্রকৃতিই মন্দির, যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্যেই ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়া যায়। ‘পত্রপুট’ কাব্যের একটি পঙ্ক্তি উল্লেখযোগ্য:
মন্দিরের রুদ্ধ দ্বারে এসে আমার পূজাবেরিয়ে চলে গেল দিগন্তের দিকে —সকল বেড়ার বাইরে,নক্ষত্রখচিত আকাশতলে,পুস্পখচিত বনস্থলিতে।
তিনি সূর্যোদয়ে
ঈশ্বরের সৌন্দর্যের সঙ্গ অনুভব করেছেন — ‘এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর’। প্রকৃতির প্রতি এই মুগ্ধতা আমাদেরও ঈশ্বরের সঙ্গে
একাত্ম করে।
প্রকৃতি-সত্তা
ও ঈশ্বরের একাত্মতা
প্রকৃতি এবং ঈশ্বর অভিন্ন। প্রকৃতি মানে
শুধু গাছপালা নয়; বরং সমগ্র জগতের
অন্তর্ভুক্তি। প্রকৃতি-সত্তা নিজেকে পুনর্গঠন ও বিবর্তিত করার
ক্ষমতা রাখে। মানুষের জীবনের আনন্দ,
দুঃখ ও প্রয়াণ প্রকৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রবীন্দ্রনাথের মতে, প্রকৃতি-সত্তার সঙ্গে আমাদের সংযোগই ঈশ্বরের সঙ্গে সংযুক্তি। প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা
এবং মুগ্ধতাই প্রকৃত ঈশ্বর-সাধনা।
উপসংহার
ঈশ্বর দূর আকাশে বা কেবল আমাদের অন্তরে সীমাবদ্ধ নন। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। প্রকৃতিই ঈশ্বরের রূপ, যা ব্রহ্মান্ডের প্রতিটি উপাদানে উপস্থিত। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য এবং দার্শনিক চিন্তায় প্রকৃতির সঙ্গে এই একাত্মতা প্রকাশ পায়। প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল হলে এখানেই আমরা স্বর্গের আনন্দ সৃষ্টি করতে পারি। প্রকৃতির ভালবাসায় মগ্ন হওয়া ঈশ্বর-সাধনার শ্রেষ্ঠ পথ। ▣