আধ্যাত্মিকতা — পাশ্চাত্য ভাবধারার আলোকে

আধ্যাত্মিকতার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘স্পিরিচুয়ালিটি’। বর্তমান যুগে ‘স্পিরিচুয়ালিটি’ শব্দটি পাশ্চাত্য দুনিয়ায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন স্পিরিচুয়ালিটি অ ওয়ার্ক, স্পিরিচুয়ালিটি অ লাভ, স্পিরিচুয়ালিটি অ ডেথ, স্পিরিচুয়ালিটি অ ন্যাচার, ইত্যাদি। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে — কী এই ‘স্পিরিচুয়ালিটি’?

Ashim Dey

স্পিরিচুয়ালিটিশব্দটির অর্থ চিরদিন একরকম থাকেনি, কালে কালে বিবর্তিত হয়ে নতুন নতুন অর্থ পরিগ্রহ করেছে একসময় স্পিরিচুয়ালিটি বলতে বোঝানো হতো কেবলই ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক’, বর্তমানে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অন্তরতর সত্তার সঙ্গে সম্পর্ক

সপ্তদশ শতাব্দীর ফ্রান্সে নতুন এক আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটে, যা বিশেষভাবে অন্তরের গভীরতম অনুভূতিগুলোকে স্পিরিচুয়ালিটির সঙ্গে যুক্ত করে বলা হয়, ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার বিষয় সেই সময় এ ধরণের কথা ছিল গির্জার অনুশাসনের বিরুদ্ধে এক ধরণের প্রতিবাদ তবে তা ছিল অসাম্প্রদায়িক, নিও-লিবারেল বা নব্য-উদারপন্থী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ

পরবর্তীতে, এই আধ্যাত্মিক চেতনা আরও বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়, এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নিউ এইজ স্পিরিচুয়ালিটিনামে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় জনপ্রিয় হয় এই আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন উইলিয়াম জেমস, গর্ডন অলপর্ট, এবং আব্রাহাম মাসলো বলা হল, প্রত্যেক মানুষের একটি নিজস্ব ব্যক্তিগত ধর্ম আছে, তারা বিশেষ কোনও ধর্মসম্প্রদায়ের সদস্য হোক বা না হোক এই অর্থে, ধর্ম হচ্ছে এক ব্যক্তিগত বিশ্ববীক্ষার নাম

স্পিরিচুয়ালিটি শব্দটির বাংলা আভিধানিক অর্থ আধ্যাত্মিকতা, ধার্মিকতা, অধ্যাত্মনিষ্ঠা, চিত্তোৎকর্ষ, আত্মোন্নয়ন, ইত্যাদি স্পিরিচুয়ালিটি সাবজেক্টিভ, অর্থাৎ ব্যক্তিগত অনুভুতির বিষয় বিধায় এক কথায় সংজ্ঞায়িত করা সহজ নয় তাই এর কিছু  বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হল

স্পিরিচুয়ালিটি-তে অবশ্যপালনীয় আদেশ-নির্দেশ নেই, যেমনটা আছে ধর্মের বেলায় স্পিরিচুয়ালিটি কোনও বিশেষ আদর্শ বা নিয়মাবলী অনুসরণ না করে নিজের হৃদয়কে অনুসরণ করার কথা বলে এবং স্বতঃলব্ধ জ্ঞানের আলোকে যা নিজের জন্য ও আশেপাশের মানুষদের জন্য সঠিক মনে হয় তাই করতে উৎসাহিত করে প্রকৃতপক্ষে, স্পিরিচুয়ালিটি মানুষকে পরলৌকিক পুরস্কারের লোভ বা শাস্তির ভয় থেকে মুক্ত হয়ে ভাল মানুষ হওয়ার কথা বলে, যার পুরস্কার কেবল অন্তরের সুখ

স্পিরিচুয়ালিটির ভিত্তি কেবলমাত্র ভালবাসা, কোনও রকম ভয়-ভীতি নয় ধর্মের সর্বাংশ জুড়ে রয়েছে ভীতিপ্রদর্শন ধর্ম-নির্দেশিত পথে না চললে রয়েছে মৃত্যুর পর শাস্তিভোগের ভয় ভয় থেকে যা করা হয় তা আত্মার জন্য অবমাননাকর, দেহ ও মনের জন্য অস্বাস্থ্যকর অন্যদিকে, মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা থেকে নিজের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে অনুপ্রাণিত করে স্পিরিচুয়ালিটি ভালবাসা থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত মানুষকে আরও শক্তিশালী ও সাহসী করে, এবং আত্মার পুষ্টি যোগায়

ধর্ম সত্যটা বলে দেয়, কিন্তু স্পিরিচুয়ালিটি সত্যটা আবিস্কার করতে বলে এই মহাবিশ্ব কবে কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে, মানব জীবনের উদ্দেশ্য কী এ সব প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট করে লেখা থাকে ধর্মগ্রন্থে কিন্তু, স্পিরিচুয়ালিটি সবকিছুতে নিজের সত্যটা নিজেই খুঁজে বের করতে উৎসাহ দেয়, এবং জানার ক্ষেত্রে কত গভীরে যাবে সে ব্যাপারে সীমা বেঁধে দেয় না

মানুষ প্রায়শ ধার্মিকতার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতা গুলিয়ে ফেলে প্রকৃতপক্ষে, কেউ আধ্যাত্মিক না হয়েও ধার্মিক হতে পারে কেউ ধার্মিক না হয়েও আধ্যাত্মিক হতে পারে আবার কেউ একসঙ্গে আধ্যাত্মিক ও ধার্মিক দুইই হতে পারে তাহলে কাকে বলব স্পিরিচুয়াল বা আধ্যাত্মিক মানুষ?

একজন মানুষ ধর্মবিশ্বাসী, নিয়মিত উপাসনালয়ে যায়, এবং যথাবিধি প্রার্থনা সম্পন্ন করে কিন্তু তার মন হিংসা-বিদ্বেষ-ঘৃণায় ভরা তাকে কি স্পিরিচুয়াল বলা যাবে? না

একজন মানুষ কোনও আধ্যাত্মিক গোষ্ঠির সদস্য, এবং নিয়মিত যোগসাধনা, মেডিটেশন করে কিন্তু তার জীবনচর্চায় মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা নেই তাকে কি স্পিরিচুয়াল বলা যাবে? না

তাহলে, কেমন হবে একজন স্পিরিচুয়াল বা আধ্যাত্মিক মানুষ? একজন আধ্যাত্মিক মানুষ হবে প্রীতিপূর্ণ, স্নেহশীল ও দয়ালু তার কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে ভালবাসা নিজের ও অন্যদের প্রতি; জীবজন্তু, প্রকৃতি, পরিবেশ ও পৃথিবীর প্রতি একজন আধ্যাত্মিক মানুষ হবে চিন্তায় বা অনুভূতিতে অত্যন্ত পরিশীলিত

তা হলে কী এই স্পিরিচুয়ালিটি যা পশ্চিমা বিশ্বের ভাবজগতে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, — ‘আধুনিক স্পিরিচুয়ালিটি এক নতুন মূল্যবোধের নাম এই মূল্যবোধের অনুষঙ্গ হচ্ছে চেতনার বিবর্তন, অসাম্প্রদায়িক সমাজ, অসামরিক সংস্কৃতি, বৈশ্বিক আদান-প্রদান, পরিবেশের নিরাময়, ভারসাম্যযুক্ত অর্থনীতি, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা, দরিদ্রের আর্থিক ক্ষমতায়ন, ভালবাসা, সমবেদনা, ধর্মীয় মৌলবাদ অতিক্রম করা, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ পরিহার করা’। 

অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা

Popular posts from this blog

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চেনার উপায়

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা — চন্দ্রসূর্যের মিলন ও বিরহ তিথি

তেল মাহাত্ম্য

ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ

রাসলীলা মাহাত্ম্য

আঁধারের রূপ ও বিপন্ন অন্ধকার

সূর্য উপাসনা

হৃদয়-দর্পনে দেখা