সূর্য উপাসনা
মানবসভ্যতার প্রারম্ভে মানুষ সূর্যের উপাসনা
করত। এটি পৃথিবীর প্রায় সব আদিম ও প্রাচীন সভ্যতায় প্রচলিত ছিল। সে যুগে সূর্য
উপাসনা ছিল জ্ঞান ও সত্যে পরিপূর্ণ এক উন্নত মানসিকতার প্রতীক।
সূর্য সমগ্র জীবনের উৎস। সূর্যের কারণেই উদ্ভিদ
টিকে আছে, আর উদ্ভিদের কারণেই প্রাণিজগৎ। সূর্যের আলো ও তাপে শস্য পরিপুষ্ট হয়,
এবং সেই শস্য থেকে আমরা জীবনের শক্তি সংগ্রহ করি। সূর্য সমস্ত
শক্তির মূল। সূর্য নিভে গেলে পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এই কারণেই
প্রাচীন মানুষ সূর্যকে ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন মনে করত এবং ভক্তিভরে তার কাছে প্রণত
হত।
সূর্য আমাদের সৌরমণ্ডলের কেন্দ্রবিন্দু এবং
আমাদের জীবনের প্রধান আশীর্বাদ। সূর্য আমাদের দেবতা। তিনিই একমাত্র দেবতা যাকে
আমরা সরাসরি প্রত্যক্ষ করতে পারি। এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমাদের বিশ্বাসকে আরও দৃঢ়
করে। আমরা দেখি, জীবনের জন্য যা প্রয়োজন, সূর্য তার সবকিছুই আমাদের
প্রদান করে — উত্তাপ, আলো, খাদ্য,
ফুল এবং এমনকী ঝিলের জলে মোহন প্রতিবিম্ব। তাই মানুষের পক্ষে
সূর্যের প্রতি ভক্তি, ভালবাসা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা
স্বাভাবিক। সূর্যের উপাসনা মানুষের সহজাত প্রতিক্রিয়া।
সূর্য উপাসনা সহজ এবং সরল। এতে কোনও রহস্যময়তা, অলৌকিকতা, আড়ম্বর, মন্দির বা পবিত্র গ্রন্থের প্রয়োজন হয় না। সবচেয়ে বড় বিষয়, সূর্য কখনও কারও প্রতি পাপ বা শাস্তির রায় দেয় না।
তবে সূর্যকে দেবতা মনে করার অর্থ পরিষ্কার হওয়া
উচিত। যখন কোনও শক্তির প্রতি চিত্ত সমর্পণ করা হয়, তখন সেই শক্তি দেবত্ব লাভ করে।
আকাশের প্রতি হৃদয় নিবেদন করলে আকাশ দেবতা হয়, নদীর কাছে
সমর্পণ করলে নদী হয় গঙ্গাদেবী বা ‘মা গঙ্গা’। পৃথিবীর প্রতি ভক্তি দিলে পৃথিবী হয় ধরিত্রীমাতা, আর
দেশের প্রতি নিবেদন করলে দেশ হয় দেশমাতৃকা। তেমনি সূর্যের প্রতি চিত্ত সমর্পণ করলে
সূর্য হয় সূর্যদেব।
প্রকৃতপক্ষে, দেবত্ব কোনও কিছুর মধ্যে নিহিত নয়। এটি হৃদয়ের সমর্পণ
থেকে সৃষ্টি হয়। সমর্পিত হৃদয়ই দেবত্ব সৃষ্টি করে এবং সেই দেবত্বের আলোয় নিজেও
আলোকিত হয়। তাই আমাদের হৃদয় নিবেদন করতে হবে সূর্যশক্তির কাছে।