তেলের সামাজিক মাহাত্ম্য
তেল শব্দটি এসেছে তিল থেকে। তিল থেকে উৎপন্ন হওয়ায় এর নাম হয়েছে তৈল
বা তেল। প্রাচীনকালে, বাংলাদেশে রান্নার
তেল হিসেবে প্রধানত তিলের তেল ব্যবহৃত হত। পরবর্তীকালে, সরিষা,
নারকেল প্রভৃতি থেকে উৎপন্ন তেল রান্নার উপকরণ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
তবে, তেলের ব্যবহার শুধু রান্নার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়;
এর প্রয়োগ অনেক বিস্তৃত।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) বলেন — 'তৈল নহিলে জগতের কোন কাজ সিদ্ধ হয় না। তৈল নহিলে কল
চলে না, প্রদীপ জ্বলে না, ব্যঞ্জন
সুস্বাদু হয় না, চেহারা খোলে না।'
তেল কেবল ব্যবহারিক অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এর রূপক অর্থও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
আরও বলেন — 'এক তেলে চাকা ঘোরে, আর-তেলে
মন ফেরে।' অর্থাৎ, পারস্পরিক
সম্পর্ক মসৃণ রাখতে মানুষ ‘তেল’ ব্যবহার করে, যা এক ধরনের
সামাজিক কৌশল বা ‘সামাজিক তেল’ বলে বিবেচিত হতে পারে।
সংস্কৃত সাহিত্যে তেলের আরেক নাম ‘স্নেহ’। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
বলেন — ‘বাস্তবিকই স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ
করি, তুমি আমায় স্নেহ কর, অর্থাৎ,
আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কি? যাহা
স্নিগ্ধ বা ঠান্ডা করে, তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠান্ডা
করিতে আর কিসে পারে?’
আধুনিক সমাজে, বিশেষত সামাজিক
মাধ্যমে, ‘সামাজিক তেল’-এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এটি
বিভিন্ন নামে ও বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। এ প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন — 'তৈলের যে রূপে আমরা গুরুজনকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম
ভক্তি; যাহাতে গৃহিণীকে স্নিগ্ধ করি, তাহার
নাম প্রণয়; যাহাতে প্রতিবেশীকে স্নিগ্ধ করি, তাহার নাম মৈত্রী; যাহা দ্বারা সমস্ত জগতকে স্নিগ্ধ
করি, তাহার নাম শিষ্টাচার ও সৌজন্য।' এখানে ‘স্নিগ্ধ করা’ অর্থে ‘তেল দেওয়া’ ব্যবহৃত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে,
পিতামাতা সন্তানের প্রতি যে স্নেহ দেখান, সেটিও
এক ধরনের তেল। কর্মস্থলে কর্তা ভৃত্যের প্রতি যে সদাচরণ করেন, সেটি শিষ্টাচার। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আচরণও তেলেরই একটি রূপ, যা ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ।
সামাজিক তেলের ব্যবহার বাস্তব জীবনে অত্যন্ত ব্যাপক। তবে, স্নেহ, ভক্তি ও ভালবাসা ইতিবাচক সামাজিক গুণ। এগুলোকে পরিহাসের চোখে দেখা অনুচিত। কারণ, মানুষ পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবে, ভালবাসবে, স্নেহ করবে — এটাই স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বর্তমানে ‘তেল’ শব্দটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। ‘তেল দেওয়া’ বলতে এখন মিথ্যা প্রশংসা বা অতিরিক্ত তোষামোদের অর্থ বোঝানো হয়। মজার বিষয় হল, সবাই কোনও না কোনওভাবে এই ‘তেল’ দিয়ে থাকেন, কিন্তু কেউই তা স্বীকার করতে চান না। ▣