চাঁদহীন পৃথিবী
পৃথিবী চাঁদহীন নয়। পৃথিবীর একমাত্র চাঁদ কোথাও
হারিয়েও যায়নি, কিংবা কোনও দিন হারিয়ে যাবে তেমন সম্ভাবনার কথা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের
কেউ এখনও বলেনি। তবু প্রসঙ্গটি মনে এল, যদি কোনও দিন মানুষ চাঁদের দখল
নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, এবং সেই যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে, সেই কথা ভেবে।
যুদ্ধ হতেই পারে, কারণ চাঁদের বুকে রয়েছে দুর্লভ
জ্বালানি সম্পদ হিলিয়াম-৩ আয়নের বিশাল ভান্ডার। মনে করা হয়, হিলিয়াম-৩ হবে দ্বিতীয় প্রজন্মের পারমাণবিক জ্বালানি। যখন চাঁদের হিলিয়াম-৩ আহরণের
উপযুক্ত প্রযুক্তি মানুষের হাতে আসবে, এবং যখন পৃথিবীর
জ্বালানি সম্পদ নি:শেষ হয়ে আসবে, তখন
চাঁদের দখল নিয়ে যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। সেই যুদ্ধে মানুষ হয়ত
পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবে না, কারণ যুদ্ধটি হবে পৃথিবী থেকে অনেক
দূরে।
শোনা যায়, প্রথম পারমাণবিক বোমাটি ফেলার পরিকল্পনা ছিল চাঁদে। পরে পরিকল্পনা পরিবর্তন
করে বোমা ফেলা হয় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে। চাঁদে পারমাণবিক বোমা ফেলার চিন্তা আবার কারও মাথায়
যে আসবে না তার নিশ্চয়তা কে দিবে!
তবে, এসব হল অনেক দূরবর্তী ভবিষ্যতের
সম্ভাবনার কথা। ততক্ষণ না হয় ভেবে দেখা যাক, চাঁদের
অবর্তমানে পৃথিবীর চালচলনে কী কী পরিবর্তন ঘটতে পারে।
আমরা জানি, পৃথিবী তার অক্ষ বা মেরুরেখার উপর
সুফি নাচের মতো পাক খেতে খেতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। নিজ অক্ষের উপর একবার
পাক খেতে পৃথিবীর সময় লাগে ২৪ ঘন্টা, আর সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে
লাগে ৩৬৫ দিন। সূর্য-প্রদক্ষিণে পৃথিবীর সাথী চাঁদ।
সফর-সঙ্গী হয়ে চাঁদ পৃথিবীকে দু’ভাবে প্রভাবিত করে। এক, পৃথিবীর অক্ষরেখা সূর্যপ্রদক্ষিণের
কক্ষপথে প্রায় ২৩° কোণ করে হেলে থাকে। ধারণা করা হয়, চাঁদের
আকর্ষণের কারণেই এমনটি হয়ে থাকে। আর অক্ষরেখা হেলে থাকার
কারণেই ঘটে দিন-রাত্রির আলো-অন্ধকারের ছন্দবৈচিত্র। একই কারণে পৃথিবীতে ঘটে
ঋতু পরিবর্তন।
কিন্তু চাঁদের অবর্তমানে পৃথিবীর অক্ষরেখাটি ঠিক
এভাবেই হেলে থাকবে কিনা তা বলা মুশকিল। যদি আর হেলে না থেকে সোজা হয়ে পৃথিবীর কক্ষপথের
সঙ্গে সমকোণ করে থাকে, তাহলে পৃথিবীর সব জায়গায় সারা বছর দিন আর রাত্রি সমান হবে। আর পৃথিবীতে ঋতু বৈচিত্র
একেবারেই বদলে যাবে, মানে, কোনও বৈচিত্রই আর থাকবে না। সারা বছর আমরা কেবল একই
বাঁধা ঋতু পাব। সম্ভবত, সেটা হবে কোনও নাতিশীতোষ্ণ ঋতু,
অনেকটা শরতের মতো।
দ্বিতীয়ত, চাঁদের আকর্ষণে মহাসাগর জুড়ে সৃষ্টি
হয় জোয়ার বা জলস্ফীতি। স্ফীতিশীল জোয়ারজল এবং আবর্তনশীল ভূপৃষ্ঠের মধ্যে
সৃষ্টি হয় একধরণের ফ্রিকশন, যার নাম ‘টাইডাল ফ্রিকশন’ বা ‘বেলোর্মী
ঘর্ষণ’। এই ফ্রিকশন পৃথিবীর আবর্তনের উপর এক ধরণের ব্রেক বা
গতিরোধক হিসেবে কাজ করে। যদি চাঁদ না থাকে, পৃথিবী আরও দ্রুত গতিতে আবর্তিত হবে। তখন আমাদের দিন হবে অনেক
ছোট। একটি মোটামুটি গণনায় বলা হয়েছে, তখন ২৪
ঘন্টার বদলে দিন হবে মাত্র ৬ থেকে ৮ ঘন্টা লম্বা। তার মানে, তখন ১,১০০ থেকে ১,৪০০ দিনে হবে এক বছর। মানুষের দেহের
প্রাণরসায়ন দিনরাত্রির আলো-অন্ধকারের ছন্দে বাঁধা। চাঁদ না থাকলে সেই ছন্দ
বিপর্যস্ত হবে, তখন বিপন্ন হবে মানুষের শরীরতত্ত্ব।
চন্দ্রগ্রহ হারিয়ে গেলে হারিয়ে যাবে পৃথিবীর
ধ্রুবতারা। মানুষের জীবন হবে বিপন্ন, ঋতুবর্ণবৈচিত্রহীন,
আসবে না বর্ষা বসন্ত। আর, চাঁদকে
ঘিরে মানুষের যত কবিত্ব, রোম্যান্টিকতা, আধ্যাত্মিকতা তাও হারিয়ে যাবে। ▣
✍অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা