বিশ্বাসের শক্তি — রোগে ও আরোগ্যে
দুই হাজার বছর আগের কথা। এক
নারী জনতার ভিড় ঠেলে যীশুর কাছে গিয়ে পৌঁছল। সে এক
দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছিল। যীশুর বস্ত্র স্পর্শ করা মাত্র তার ব্যাধি দূর হয়ে
গেল। যীশু তখন সেই নারীকে বললেন, এটা তার বিশ্বাস যা তাকে সুস্থ করেছে।
মানুষ অনেক কিছু বিশ্বাস করে, কিন্তু বিশ্বাসের শক্তি সম্পর্কে সবসময় অবগত হয় না।
বিশ্বাসের শক্তি অপরিসীম। বিশ্বাস মানুষকে ভেঙেচুরে নতুন করে সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্বাসের কারণে মানুষ হতে পারে দরবেশ, অথবা হিংস্র অমানুষ।
বিশ্বাস মানুষের শরীরতত্ত্বে আনতে পারে বিপুল পরিবর্তন।
বিশ্বাসের কারণে মানুষ হতে পারে অসুস্থ, আবার বিশ্বাসের কারণেই হতে পারে তার
রোগ নিরাময়।
কেউ যদি প্রবলভাবে বিশ্বাস করে, কোনও কিছু তাকে অসুস্থ করতে পারে, তবে নিজের ভয়
থেকেই সে অসুস্থ হতে পারে। আবার কোনও বিশ্বাস যদি সেই ভয় দূর করতে পারে, তাহলে সে আরোগ্য লাভ করতে পারে। এ-প্রসঙ্গে একটি গল্পের অবতারণা করছি।
একজন মানুষ মুখ খোলা রেখে ঘুমোতেন। দীর্ঘ
দিনের অভ্যেস, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। একবার
এক অতিথি এসে তাকে এই ভাবে ঘুমোতে দেখে বলল, আপনি যে মুখ খোলা রেখে ঘুমান তা
কিন্তু খুবই বিপজ্জনক — হঠাৎ মুখে মাছি ঢুকে যেতে পারে।
এ কথা শোনার পর লোকটি মহা দুশ্চিন্তায় পরে গেল। সত্যি
তো, এতদিন যে মাছি ঢোকেনি সেটাই আশ্চর্য! তবে এখন থেকে
সে আর মুখ খোলা রেখে ঘুমোবে না, সেটাই সিদ্ধান্ত হল।
কিন্তু মুখ বন্ধ করে ঘুমোনো তার জন্য সহজ হল না, দীর্ঘ
দিনের অভ্যেস। সে অনেক চেষ্টা করল মুখ বন্ধ করে ঘুমোতে।
কিন্তু মুখ বন্ধ করলে ঘুম আসে না, ঘুম এলেও কিছুক্ষণ পরপর তা ভেঙে যায়
আতঙ্কে — এই বুঝি মুখ খুলে গেছে, এই
বুঝি মাছি ঢুকে পড়েছে!
কিছুদিন পর, একদিন সত্যি তার শরীরের মধ্যে মাছি
ঢুকে পড়ল। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সে অনুভব করল একটি মাছি তার
শরীরের মধ্যে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটোছুটি করছে। ভীষণ
অস্বস্তিকর অবস্থা।
সে শহরের একজন নামী ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করল। সারা
শরীরে আলট্রাসনোগ্রাফি করা হল। কিন্তু কোনও মাছির অস্তিত্ব ধরা পড়ল না।
ডাক্তার বললেন, শরীরের মধ্যে কোথাও মাছি নেই। কিন্তু
নেই বললেই তো আর হল না! সে যে সারাক্ষণ ভুগছে মাছির
জ্বালাতনে সেটা কি তবে মিথ্যে!
এরপর সে আরও কয়েকজন নামীদামী ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করল। সবাই
পরীক্ষানিরীক্ষার পর একই কথা বললেন, শরীরের মধ্যে কোনও মাছি ছুটোছুটি
করতে পারে না, এটা অসম্ভব।
অবশেষে হতাশ হয়ে সে একজন সাধুর সঙ্গে দেখা করল। সাধু
সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে তাকে একটি বিছানার উপর শুইয়ে দিয়ে তার সারা শরীর
পরীক্ষানিরীক্ষা করতে লাগলেন। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা
করলেন। অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর হঠাৎ উল্লাসিত হয়ে বললেন, এই পেয়েছি, তোর হাঁটুর গিঁটের মধ্যে মাছিটি লুকিয়ে
আছে এখন।
এ কথা বলে সাধু বাড়ির ভেতর গেলেন কেন যেন। ফিরে
এলেন একটু পরেই, বললেন, এইবার
মাছিটিকে আমি বের করে আনবো। নানারকম কেরামতি প্রয়োগ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই সাধু
মাছিটিকে বের করে আনলেন। একটি জ্যান্ত মাছি দুই আঙ্গুলে ধরে বললেন, দ্যাখ, এই মাছিটি এতদিন তোকে জ্বালাতন করছিল। এখন
তুই সম্পূর্ণ নিরাপদ, আর ভয় নেই।
লোকটি বিস্ময়ে আনন্দে অভিভূত হয়ে সাধুকে প্রনাম করল।
পরক্ষণেই এক রাশ ক্ষোভ তার মন আচ্ছন্ন করল। সে
ছুটে গেল সেই ডাক্তারদের কাছে। তাদের বলল, তোমরা তো কেউ আমার শরীরে মাছি খুঁজে
পেলে না, কিন্তু সাধুবাবা খুঁজে পেয়েছেন এবং বের করেও এনেছেন,
এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।
ডাক্তারবাবুরা অবাক হয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বললেন। তারপর
গেলেন সাধুবাবার সঙ্গে দেখা করতে। তাঁরা সাধুবাবাকে বললেন, এটা কি করে সম্ভব, এটা যে সম্পূর্ণ অসত্য, অবৈজ্ঞানিক!
সাধুবাবা স্মিত হেসে বললেন, আমার চিকিৎসাপদ্ধতি আপনাদের দৃষ্টিতে অসত্য, অবৈজ্ঞানিক
মনে হতে পারে, কিন্তু আমার চিকিৎসায় কাজ হয়েছে সেটা সত্য।
তাহলে বিজ্ঞানসম্মত সত্যটা কী? বিজ্ঞানে যা সত্য বলে গ্রহণ করা হয় তা তো আসলে ‘হাইপোথিসিস’। যখন
যে হাইপোথিসিস কার্যকর বলে প্রমাণিত হয় সেটিকেই তখন সত্য বলে মনে করা হয়। পরবর্তিতে
কেউ যদি অধিকতর কার্যকর কোনও হাইপোথিসিস নিয়ে এগিয়ে আসে তখন আগেরটি বাতিল করে
পরেরটিকে নতুনতর সত্য বলে গ্রহণ করা হয়। কোন
হাইপোথিসিস কতবেশি কার্যকর সেটাই বড় কথা।
এটা ঠিক যে, মূলধারার চিকিৎসাবিজ্ঞানে সাধুর
চিকিৎসাপদ্ধতির যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কিন্তু বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা, যেমন মনোবিজ্ঞান বা দেহমনগত
চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর যথার্থতা খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না।
এমনকী আধুনিক চিকিৎসাগবেষণায় রোগে ও
আরোগ্যে বিশ্বাসের ভূমিকা নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে আজকাল, তৈরি
হচ্ছে নতুন নতুন তত্ত্ব, পরিভাষা। যেমন, ‘বিশ্বাস’ থেকে যে প্রক্রিয়ায় রোগ সৃষ্টি হয় তাকে বলে
‘Nocebo Effect’ বা ‘নসিবো ইফেক্ট’,
এবং বিশ্বাস যে প্রক্রিয়ায় রোগ নিরাময় করে তাকে বলা হয় ‘Placebo
Effect’ বা ‘প্লাসিবো ইফেক্ট’।
কোনও ওষুধ গ্রহনের আগে রোগী যদি ওষুধটির পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বা ক্ষতিকর দিক, যেমন বমনেচ্ছা, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি সম্পর্কে অতিসচেতন
হয়ে পড়ে, তাহলে অনেক সময় দেখা যায় মূল রোগ নিরাময়ের পরিবর্তে
পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াগুলোই প্রকট হয়ে উঠেছে। এটা ‘নসিবো ইফেক্ট’। আবার ডাক্তার যদি অনিদ্রার রোগীকে কোনও ভিটামিন বা
এন্টিঅক্সিডেন্ট ট্যাবলেট দিয়ে বলেন এটা খুব শক্তিশালী ঘুমের ওষুধ এবং রোগী
বিশ্বাস করে তা গ্রহণ করে, তাহলে তার খুব ভাল ঘুম হওয়ার কথা। এটা ‘প্লাসিবো ইফেক্ট’।
বিশ্বাস থেকে যে রোগ ও আরোগ্য দুই-ই হতে পারে তা
আমাদের প্রাচীন লোকজ চিকিৎসকদের জানা ছিল। তারা
জানত, জিনের আছরে বিশ্বাসের কারণে মানুষ অসুস্থ হতে পারে, আবার
ঝাড়-ফুঁকে বিশ্বাসের কারণে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। আজও
লোকজ চিকিৎসায় রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয় মন্ত্র, দোয়া, প্রার্থনা,
পাথর, পানিপড়া, গাছের
শিকড়-বাকল, তাবিজ-কবজ, ইত্যাদি। এই সব
লোকজ চিকিৎসার কার্যকারিতার মূলে রয়েছে ‘প্লাসিবো ইফেক্ট’; চিকিৎসাপদ্ধতিতে অগাধ বিশ্বাস এবং আরোগ্যে দৃঢ় প্রত্যাশা যার শর্ত।
এ প্রসঙ্গে, মার্কিন জীববিজ্ঞানী এবং
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিন-এর সাবেক
গবেষক ব্রুস লিপ্টন বলেন — If the brain expects that
a treatment will work, it sends healing chemicals into the bloodstream, which
facilitates that. That’s why the placebo effect is so powerful for every type
of healing. And the opposite is equally true and equally powerful: when the
brain expects that a therapy will not work, it doesn’t. It’s called the ‘nocebo
effect’. অর্থাৎ, চিকিৎসাপদ্ধতিতে গভীর
বিশ্বাস, তা সে যে পদ্ধতিই হোক না কেন, রোগীর দেহের নিজস্ব নিরাময় ক্ষমতাকে সক্রিয় করে তোলে, আর সেকারণেই রোগী আরোগ্য লাভ করে। ■
✍অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা