আঁধারের রূপ ও বিপন্ন অন্ধকার
কোথাও আলো জ্বালতে গেলে দেখা যায় অন্ধকার আগেই সেখানে গিয়ে বসে আছে। তবে কি
অন্ধকারের গতি আলোর গতির চেয়ে বেশি? না, তা নয়। আলোর গতি আছে, কিন্তু অন্ধকারের গতি নেই। কারণ অন্ধকার
সদা সর্বত্র বিদ্যমান। মহাকাশের শূন্য স্থান, যেখানে কিছুই দেখা যায় না, আসলে
‘ডার্ক এনার্জি’-তে ভরা। সে কারণেই, আলো জ্বালতে হয়, কিন্তু অন্ধকার
জ্বালাতে হয় না। অন্ধকার শাশ্বত।
বলা হয়ে থাকে, অন্ধকার অজ্ঞতার
প্রতীক। কিন্তু বিজ্ঞতার প্রতীক, নিশাচর প্যাঁচাকে জিজ্ঞেস করলে বলবে — অন্ধকার জ্ঞান
ও বিজ্ঞতার প্রতীক। প্রকৃতপক্ষে, অন্ধকার হতে পারে বিভিন্ন রকমের, যেমন ভীতিপ্রদ
অন্ধকার, প্রশমনকারী অন্ধকার, বিশ্রামপ্রদ
অন্ধকার, প্রণয়ী-প্রণয়িনীর অন্ধকার। তবে অন্ধকার
সম্পূর্ণভাবে শুভ বা অশুভ, মঙ্গল বা অমঙ্গল,
বিজ্ঞতা বা অজ্ঞতা নয়। যে যে-ভাবে অন্ধকারকে দেখতে চায়, তার
চোখে অন্ধকার সে-ভাবেই প্রতিভাত হয়।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চোখে অন্ধকার প্রতিভাত হয়েছিল সৌন্দর্যময়
সত্তা হিসেবে। তিনি অন্ধকারের রূপে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন — “হঠাৎ চোখের উপরে যেন সৌন্দর্যের তরঙ্গ খেলিয়া গেল। মনে হইল, কোন মিথ্যাবাদী প্রচার করিয়াছে — আলোরই রূপ, আঁধারের রূপ নাই? ... এই যে আকাশ-বাতাস স্বর্গ-মর্ত্য
পরিব্যাপ্ত করিয়া দৃষ্টির অন্তরে-বাহিরে আঁধারের প্লাবন
বহিয়া যাইতেছে, মরি! মরি! এমন অপরূপ রূপের প্রস্রবণ আর কবে দেখিয়াছি! এ
ব্রহ্মান্ডে যাহা যত গভীর, যত অচিন্ত, যত
সীমাহীন — তাহা তো ততই অন্ধকার।” অন্ধকার সৌন্দর্যময়। শুধু তাই নয়, অন্ধকার বস্তুর সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যোগ করে। আর সে কারণেই
রাতের অন্ধকারে পৃথিবী মোহিনী রূপ ধারণ করে।
অন্ধকারমন্ডিত বলেই রাত্রি এতো সুন্দর, এতো জাঁকালো, এতো জীবন্ত। আঁধার বিছানো
বলেই রাতের আকাশে জ্বলে সহস্র কোটি তারার প্রদীপ। অন্ধকার না
থাকলে আমরা কোনও দিনই দেখতে পেতাম না তারায় ভরা আকাশ। অন্ধকার যত গভীর, তারারা তত উজ্জ্বল।
কিন্তু এই অন্ধকার আজ বিপদাপন্ন। সভ্যতার
আলোকপ্রাপ্ত মানুষ সংকল্প করেছে, পৃথিবী থেকে সব অন্ধকার দূর করে ছাড়বে। আর তা করতে
গিয়ে বিনষ্ট করছে আকাশের অন্ধকার। সম্প্রতি, ‘সায়েন্স এডভান্সেস’ সাময়িকীতে প্রকাশিত এক
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, বিশ্বে ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ আজ
রাত্রিকালীন আলো দুষণে আক্রান্ত; তারা স্বাভাবিক তারায় ভরা
রাতের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি উজ্জ্বল আকাশের নীচে বাস করছে।