হাসির মর্যাদা

পৃথিবীতে মানুষই সম্ভবত একমাত্র প্রাণী যে হাসতে পারে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, কথা বলতে শেখার লক্ষ লক্ষ বছর আগে মানুষ হাসতে শিখেছে আমাদের আদিম পূর্বপুরুষরা সম্ভবত হাসির মাধ্যমেই মনের অনেক ভাব আদানপ্রদান করত হাসি মানুষের ইনস্টিংক্ট বা সহজাত প্রবৃত্তি, মানবশিশু জন্মের প্রায় পর-পরই হাসতে পারে এমনকি যেসব শিশু জন্ম থেকেই অন্ধ ও বধির যারা কোনও দিন কাউকে হাসতে দেখেনি বা শুনেনি তারাও হাসতে পারে

মানুষ সাধারণত মনের ভাল লাগার অনুভূতি প্রকাশ করে হাসির মাধ্যমে এই হাসি স্বত:স্ফূর্ত অনায়াস; সচেতন মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় মানুষ অবশ্য স্বেচ্ছায়, স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও হাসতে পারে; যেমন কপট হাসি উভয় ক্ষেত্রেই মনে ভাল লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয় কারণ উভয় ক্ষেত্রেই দেহে এন্ডরফিন নামের এক ধরণের হরমোন নিঃসৃত হয় যার প্রভাবে দেহ-মনে ভাল লাগার অনুভূতি সঞ্চারিত হয়

অনেকে মনে করেন হাসি স্বাস্থ্যপ্রদ বলা হয়ে থাকে, ‘প্রতিদিন হাসলে ডাক্তার দূরে থাকে’, ‘হাসি শ্রেষ্ঠ ওষুধ’, ইত্যাদি মানুষের মন প্রফুল্ল থাকলে তার শারীরিক স্বাস্থ্যও ভাল থাকবে সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু আমেরিকার মেরিল্যান্ড বাল্টিমোর কাউন্টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান এবং স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবার্ট প্রভিন মনে করেন, আমাদের সুখানুভূতি বা স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য হাসির উদ্ভব ঘটেনি হাসির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল অন্যদের মধ্যে ইতিবাচক অনুভূতি সঞ্চারিত করা হাসি সহজেই অন্যদের মাঝে সংক্রমিত হয় যখন কেউ হাসতে থাকে তখন তার আশেপাশের মানুষরাও হাসতে শুরু করে কে হাসছে কেন হাসছে তা জানার প্রয়োজন হয় না কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই নিরুদ্বেগ ও প্রফুল্ল বোধ করে এবং তাদের মধ্যে একধরণের ঐক্যের ভাব অনুভূত হয় সমাজ বিকাশের গোড়ার দিকে মানুষ ছোট ছোট দলে বাস করত অধ্যাপক প্রভিন মনে করেন, দলের মানুষদের প্রফুল্ল ও ঐক্যবদ্ধ রাখতেই একসময় স্বত:স্ফূর্ত স্বাভাবিক হাসির উদ্ভব ঘটেছিল

কিন্তু আজ স্বত:স্ফূর্ত হাসির সেই আগের তাৎপর্য যেন হারিয়ে যাচ্ছে আধুনিক ভদ্র মানুষের পক্ষে হাসি যেন এক অসংযত অসংগত ব্যাপার একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে,হাসিআমাদের সমাজে মোটেও প্রশংসিত কোনও আচরণ নয় বিদ্যালয়, বিচারালয়, উপাসনালয়, মন্ত্রণালয় সর্বত্র হাসি আইনত নিষিদ্ধ না হলেও সামাজিকভাবে নিরুৎসাহিত আমাদের সমাজে হাস্যবান মানুষকে ব্যক্তিত্বহীন, অপেশাদার, বা হালকা মনের মানুষ বলে মনে করা হয় 'তাসের দেশ'-এর মত আমাদের সমাজের কর্ণধাররাও মনে করেন, হাসি একটি লঘু চিত্তের কাজ; হয়ত ভয় করেন যদি হাসিতে হাওয়া হালকা হয়ে যায়, হালকা হাওয়ায় ঝড় উঠে, আর সেই ঝড়ে সব নিয়ম-নীতি উড়ে যায়! তাই সমাজে গাম্ভীর্যের মুখোশের এত কদর

মানুষ যখন হাসে তখন তার অন্তরের সৌন্দর্য বাইরে ঠিকরে পড়ে তাই হাসলে মানুষকে সুন্দর দেখায় হাসলে মানুষের মন প্রফুল্ল হয় হাসলে মনের মলিনতা দূর হয় সর্বোপরি, হাসলে মানুষ বদলায়, আর মানুষ বদলালে পৃথিবী বদলায়।

আর হাসি সহজেই অন্যদের মধ্যে সঞ্চারিত হয় তাই হাসির মাধ্যমে সুন্দর নির্মল প্রফুল্ল মনের মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ সমাজ গঠন করা আজও সম্ভব প্রয়োজন শুধু হাসির হারানো মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়ে সমাজের সর্বস্তরে অকপট স্বাভাবিক হাসির স্বীকৃতি দেওয়া। 

অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা 

Popular posts from this blog

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চেনার উপায়

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা — চন্দ্রসূর্যের মিলন ও বিরহ তিথি

তেল মাহাত্ম্য

ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ

রাসলীলা মাহাত্ম্য

আঁধারের রূপ ও বিপন্ন অন্ধকার

আধ্যাত্মিকতা — পাশ্চাত্য ভাবধারার আলোকে

সূর্য উপাসনা

হৃদয়-দর্পনে দেখা