পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে বাস্তবতা: কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও রবীন্দ্রনাথ
আমরা যখন আকাশের দিকে তাকাই, চাঁদকে দেখতে পাই। কিন্তু যখন তাকাই না, তখনও কি
চাঁদ সেখানে থাকে?
এই প্রশ্নটি তুলেছিলেন বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন।
কারণ, সে সময় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নতুন শাখায় ‘অবজারভার
ইফেক্ট’ বা ‘পর্যবেক্ষক প্রভাব’ নামক
একটি তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা চলছিল। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনও বস্তুর
অবস্থা বা দশা নির্ধারিত হয় একজন সচেতন পর্যবেক্ষকের উপস্থিতির ভিত্তিতে।
পর্যবেক্ষণ শুধু তথ্য সংগ্রহই করে না, বরং বাস্তবতার
প্রকৃতিতেও প্রভাব ফেলে।
এই প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ: ‘পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় রহস্য — দেখবার বস্তুটি নয়, যে দেখে সেই মানুষটি।’
![]() |
সম্ভাবনা পর্যায়ের চাঁদ |
প্রশ্ন জাগে — যখন আমরা চাঁদের দিকে তাকাই না, তখনও কি চাঁদ সেখানে থাকে? কোয়ান্টাম
তত্ত্ব অনুসারে, এই প্রশ্নের উত্তর হল: আমাদের দৃষ্টির আড়ালে
যাওয়া মাত্রই চাঁদের অস্তিত্ব এক অনির্ধারিত সম্ভাবনার পর্যায়ে চলে যায়। কারণ,
একজন সচেতন পর্যবেক্ষকের অনুপস্থিতিতে বস্তু প্রকৃত অর্থে নির্দিষ্ট
অবস্থায় থাকে না, বরং সম্ভাবনার একাধিক রূপে বিরাজ করে।
এটি হয়তো অবিশ্বাস্য বা আপাতদৃষ্টিতে অযৌক্তিক মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতি আমাদের প্রচলিত যুক্তির গণ্ডিতে আবদ্ধ
নয়। ২০১২ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল বিজয়ী ফ্রান্সের সার্জ হ্যারোশ ও
যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড প্রমাণ করেছেন যে, কোয়ান্টাম
মেকানিক্সের নিয়মগুলি আপাতদৃষ্টিতে অযৌক্তিক মনে হলেও তা অলীক নয়।
জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ১৯৩২ সালে কোয়ান্টাম
মেকানিক্সের ভিত্তি স্থাপনের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তার চার বছর আগে, ১৯২৮ সালে, তিনি কলকাতায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ধারণা করা হয়, তাঁরা
কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে আলোচনা করেছেন, এবং রবীন্দ্রনাথ
পর্যবেক্ষকের ভূমিকা সংক্রান্ত এই তত্ত্বের অভিনবত্বে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেও ‘অবজারভার ইফেক্ট’-এর ধারণার প্রতিফলন দেখা
যায়। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর কবিতায় প্রকৃতির
সৌন্দর্য প্রায়শই ব্যক্তির চেতনার প্রতিফলন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে প্রকৃতির
বিভিন্ন উপাদান — আলো, ছায়া, নদী বা
ফুল — শুধুমাত্র বস্তুগত অস্তিত্ব নয়, বরং কবির দৃষ্টির
মাধ্যমে নতুন অর্থ ও রূপ লাভ করে।
এমন ধারণার সমর্থনে রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা যেতে
পারে: কবি তাকান বলেই তাঁর চেতনার রঙে পান্না হয় সবুজ, চুনি হয় রক্তিম। তিনি গোলাপের দিকে চেয়ে বলেন
‘সুন্দর’, তাই গোলাপ সুন্দর হয়ে ওঠে। নব ফাল্গুনের দিনে যখন
তিনি আপন রঙে রাঙিয়ে দেন ফুল, তখনই সেই ফুল কবির চেনা হয়ে
ওঠে। অর্থাত্, রবীন্দ্রনাথের রচনায় প্রকৃতি
কেবল একগুচ্ছ বস্তু নয়, বরং এটি পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গির
উপর নির্ভর করে নতুন অর্থ ধারণ করে।
কোয়ান্টাম বাস্তবতার সূত্রানুসারে — কেউ দেখে বলেই চাঁদ ওঠে, ফুল ফোটে। কেউ চেতনার রঙে রাঙিয়ে তোলে বলেই চাঁদ সুন্দর হয়, ফুল সুন্দর হয়ে ওঠে। ▣