নার্সিসাস — রূপান্তরিত ফুলের রূপকথা
মানুষের দেহকোষে থাকে দুই ধরনের ক্রোমোসোম — স্ত্রী-ক্রোমোসোম এবং
পুং-ক্রোমোসোম। একজন নারীর শরীরে থাকে কেবলমাত্র স্ত্রী-ক্রোমোসোম, ফলে তিনি জৈবিকভাবে সম্পূর্ণ নারী। অন্যদিকে একজন
পুরুষের শরীরে একই সঙ্গে উপস্থিত থাকে পুং ও স্ত্রী — যেন তিনি অর্ধনারীশ্বরের এক
জীবন্ত রূপ; তাঁর ভিতরেই অদৃশ্যভাবে বাস করে নরশক্তি ও
নারীশক্তি। নর ও নারীর মধ্যে যেমন প্রেম জন্ম নেয়, তেমনি
মানুষের নিজের মধ্যস্থিত দুই শক্তির মধ্যেও কখনও কখনও প্রেমে আবিষ্ট হওয়ার
সম্ভাবনা থাকে — একে বলা যায় আত্মরতি বা আত্মপ্রেম। এই আত্মরতির এক মনোজাগতিক
প্রতিমূর্তি আমরা দেখতে পাই গ্রিক পুরাণে।
‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’র একটি শ্লোক মনে পড়ে —'যে যে ভাবে আবিষ্ট হয়ে শরীর ত্যাগ করে, সে সেই
রূপেরই শরীর নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে।’ নার্সিসাসের
ক্ষেত্রেও যেন সেই কথাটি সত্য হয়ে ওঠে। আত্মরতির আকাঙ্ক্ষায় আবিষ্ট হয়ে যখন সে দেহ
ত্যাগ করল, তখন পরবর্তী জন্মে সে এমন এক দেহ লাভ করল,
যা আত্মরতির জন্য একেবারেই উপযুক্ত — উদ্ভিদের দেহ। কারণ, অনেক সপুষ্পক উদ্ভিদে একই ফুলে পুংকেশর ও গর্ভকেশর থাকে; তারা স্ব-পরাগায়নের মাধ্যমে আত্মরতি সম্পন্ন করে। বলা হয়, নার্সিসাসও পুনর্জন্মে এমনই এক ফুল-গাছে রূপান্তরিত হয় — যার নাম হল
‘নার্সিসাস’। মনোমুগ্ধকর রঙ আর অতুল সুগন্ধে ভরপুর নিখুঁত গঠনের এই ফুল আজও
আত্মরতির প্রতীক হয়ে বেঁচে আছে। স্পেনের চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি তাঁর বিখ্যাত
চিত্রকর্ম ‘মেটামরফোসিস অব নার্সিসাস’-এ
এই পৌরাণিক রূপান্তরটিকে অসাধারণ শিল্পিত রূপ দিয়েছেন।
নিজের রূপে-গুণে মুগ্ধ হওয়া, নিজের প্রতি মমতা অনুভব করা — এগুলো মানবমনের স্বাভাবিক, এমনকী প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য। যে ব্যক্তি নিজেকে ভালবাসতে পারে না, সে প্রায়ই জীবনের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ে। কিন্তু মনোবিদরা বলেন, অতিরিক্ত আত্মপ্রেম বা আত্মমুগ্ধতা একসময় মানসিক বৈকল্যে রূপ নিতে পারে।
বিংশ শতকের প্রথম দিকে মানবমনের এই অতিরঞ্জিত আত্মরতি, আত্মমুগ্ধতা
ও আত্মমুখীনতার প্রকাশ বোঝাতে 'নার্সিসিজম' শব্দটি মনোবিজ্ঞানে স্থান পায়।
নার্সিসিজম নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেকারও মধ্যে দেখা দিতে পারে। এর
চূড়ান্ত পর্যায়ে কেউ কেউ আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বে চুমু খায়, কিংবা আয়নাকে কেন্দ্র করে স্বমেহনে লিপ্ত হয়। আধুনিক
মনোবিজ্ঞান এটিকে ব্যাধি বলে চিহ্নিত করলেও, এ বিষয়ে প্রশ্ন
জাগে — যদি কারও ভালবাসার কেন্দ্র নিজে-ই হয়, তবে তাতে
অসুস্থতার কলঙ্কই বা কেন? ভালবাসা তো স্বভাবতই নিজেকে থেকেই
শুরু হওয়া উচিত।
ধর্ম ও সমাজ বরাবরই আমাদের শিখিয়েছে — সবকিছুকে ভালবাসো, শুধু নিজেকে বাদ দিয়ে। প্রতিবেশীকে ভালবাসো, দরিদ্রকে ভালবাসো, জীবজন্তুকে ভালবাসো, কিন্তু নিজের প্রতি ভালবাসা — অহংকার। অথচ আত্মপ্রেম মানে আত্মবিশ্বাস;
যে নিজেকে শ্রদ্ধা করে, তাকে সহজে নিয়ন্ত্রণ
করা যায় না, তাকে ব্যবহার করা যায় না। তাই হয়তো
ইতিহাস-সংস্কৃতি যৌথভাবে আত্মপ্রেমকে সন্দেহের চোখে দেখেছে।
যখন মানুষ নিজেকে ভালবাসে, তখন সে নিজের রূপ ও সত্তাকে যত্ন করে সাজিয়ে তোলে — তখন সে হয়ে ওঠে সবচেয়ে
সুন্দর। রূপচর্চার শুরুই হয়েছে এই আত্মপ্রেম থেকে। শুধু মেয়েরা নয়, আজকাল বহু শহুরে পুরুষও নিজের দেহসৌন্দর্য রক্ষায় মনোযোগী — এদের বলা হয়
‘মেট্রোসেক্সুয়াল’। নিজেকে ভালবাসা শেষ পর্যন্ত এক ধরনের শিল্পকর্মই হয়ে ওঠে।
