নার্সিসাস — রূপান্তরিত ফুলের রূপকথা
গ্রিক পুরাণের গল্পে নার্সিসাস নামে এক রূপবান যুবক
ছিল। সে দিঘির জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজের রূপে
মুগ্ধ হয়, এবং নিজের প্রেমে পড়ে। সে-প্রেম এমন তীব্র ও গভীর ছিল যে,
সে নিজের সঙ্গে রতিমিলনের জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠে।
কিন্তু মানবদেহের গড়ন আত্মরতির উপযোগী না হওয়ায় তার মনোবাসনা পূরণ হয় না। কেবল
আকাঙ্ক্ষার আগুনে পুড়ে ছাই হয় তার দেহ।
মেটামরফোসিস অব নার্সিসাস/দালি
|
শ্রীমদ্ভগবদগীতায় আছে — ‘যে যে-ভাবে আবিষ্ট হয়ে শরীর ত্যাগ করে, সে সেই রকম শরীর প্রাপ্ত হয়’। এমনটিই ঘটেছে নার্সিসাসের বেলায়। নার্সিসাস আত্মরতির আকাঙ্ক্ষায় আবিষ্ট হয়ে দেহ ত্যাগ করে। পরিণামে সে এমন একটি দেহ প্রাপ্ত হয় যা আত্মরতির জন্য উপযুক্ত। সেই দেহ হয় এক উদ্ভিদের দেহ। পরবর্তী জীবনে নার্সিসাস উদ্ভিদ হয়ে জন্ম নেয়; যে উদ্ভিদের একই ফুলে পুংকেশর ও গর্ভকেশর বিদ্যমান। উভলিঙ্গ গাছ পরাগমিলনের মাধ্যমে আত্মরতি সম্পন্ন করে থাকে। যুবক নার্সিসাসের নাম অনুসারে এই উদ্ভিদের নাম হয় ‘নার্সিসাস’, অতি সুগন্ধ ও বর্ণময় ফুলবিশিষ্ট গাছ। গ্রিক পুরাণের এই গল্পটি অতি সুন্দরভাবে চিত্রিত করেছেন স্পেনের চিত্রকর সালভাদর দালি তাঁর ‘মেটামরফোসিস অব নার্সিসাস’ নামক চিত্রকর্মে।
নিজের রূপে-গুণে মুগ্ধ হওয়া, নিজেকে ভালবাসা মানবমনের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। যে
ব্যক্তি নিজেকে ভালবাসে না, তার পক্ষে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা
কঠিন, তাদের অনেকেই হয়ত ব্রিজের উপর থেকে ঝাঁপ দেয়। তবে
মনোবিদরা মনে করেন, নিজের প্রতি অত্যাধিক ভালবাসা বা
আত্মপ্রেম এক ধরনের রোগ, যা দেহমনে নানা ধরনের বিকৃতি বা
বৈকল্যের কারণ হতে পারে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, মানবমনের এই অবস্থা, বিশেষত অত্যাধিক আত্মমুগ্ধতা,
আত্মপ্রেম, আত্মরতি বোঝাতে ‘নার্সিসিজম’ নামে একটি পরিভাষিক শব্দ মনোবিজ্ঞানে
যুক্ত করা হয়।
উল্লেখ্য, নারী ও পুরুষ উভয়ই নার্সিসিজম-এ আক্রান্ত হতে পারে। এই রোগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের উপসর্গ হচ্ছে — আক্রান্ত ব্যক্তি আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বে চুমু খায়, আয়নায় নিজেকে দেখে স্বমেহন করে। এতে
দোষের কী আছে, এবং কেনই বা এটাকে অসুস্থতা বলে আখ্যায়িত
করা হয়, তা বোধগম্য নয়।
আমাদের ধর্ম ও
সমাজ সবকিছুকেই ভালবাসতে বলে, শুধু নিজেকে বাদে। বলা
হয়, প্রতিবেশীকে ভালবাসো, দরিদ্রকে ভালবাসো, জীবজন্তুকে ভালবাসো, কিন্তু নিজেকে নয়। কারণ, নার্সিসিজম মানে আত্মবিশ্বাস। যে
ব্যক্তি নিজেকে ভালবাসে, সে হয় আত্মবিশ্বাসী ও স্বাধীনচেতা,
তাকে সহজে ব্যবহার করা যায় না।
যখন কেউ নিজেকে ভালবাসে তখন সে হয় সবচেয়ে সুন্দর। কারণ তখন সে
নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলে, নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করে। রূপচর্চার শুরু
নার্সিসিজম থেকেই। এটা অসুস্থতা নয়, এটা শিল্পকর্ম। শুধু মেয়েরাই রূপচর্চা করে না, আজকাল অনেক শহুরে পুরুষ রূপচর্চা করে থাকে, এদের বলা হয় ‘মেট্রোসেক্সুয়াল’।
সর্বোপরি, গ্রিক পুরাণের ‘নার্সিসাস’ গল্পটিতে একটি বার্তা লুকানো আছে। বার্তাটি হচ্ছে, যারা নার্সিসিস্ট, অর্থাৎ
আত্মপ্রেমী তারা পরবর্তী জীবনে সপুষ্পক উদ্ভিদ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করে। এর চেয়ে সুন্দর
সুসমাচার আর কী হতে পারে! ▣
✍অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা