যুক্তিহীনতা — মননে ও সৃজনে
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন — ‘মানুষ যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী।’ তিনি যে অর্থেই কথাটা বলে থাকুন না কেন, প্রত্যেক মানুষ যে নিজেকে যুক্তিবাদী মনে করে তা বোধহয় ঠিক। নিজের সমস্ত আচরণই নিজের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়।
প্রকৃতপক্ষে, যুক্তি আলাদিনের চেরাগের মতো — যখন যার অধীন তার অভীষ্ট সিদ্ধ করে। মানুষ যখন যা করে তার পিছনে নিজস্ব যুক্তি থাকে। কোনও না কোনও যুক্তির সমর্থন ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। একজন আস্তিক কিংবা নাস্তিক, একজন ধার্মিক কিংবা সন্ত্রাসী, একজন সাধু কিংবা ঠগ — প্রত্যেকেরই নিজের বিশ্বাস ও আচরণের পিছনে নিজস্ব যুক্তি থাকে। নিজস্ব যুক্তি থেকে আসে দ্বৈত-যৌক্তিকতা; অর্থাৎ কোন আচরণটি যৌক্তিক তা ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন হয়। অনেক সময়, নিজের সুবিধার জন্য দুটি বিপরীত যুক্তিকেই গ্রহণ করা হয়। বলা বাহুল্য, এসব যুক্তি মানুষের তৈরি; নিজেদের আচরণকে অন্তত নিজের কাছে যৌক্তিক করে তোলার উপায় মাত্র।
প্রকৃতি মানুষের তৈরি যুক্তির ধার ধারে না। তাই প্রকৃতিকে
বুঝতে হলে মানুষের তৈরি যুক্তি থেকে বের হয়ে আসতে হয়। পদার্থবিজ্ঞানী
আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ মানুষের কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। এই তত্ত্ব অনুসারে, একজন মানুষ যদি আলোর গতিতে চলমান হয় তাহলে তার বয়স কখনও বাড়বে না। ধরুন, আপনি আজ একটি
মহাকাশযানে চড়ে মহাকাশ ভ্রমনে যাত্রা করলেন। মহাকাশযানটি
সবসময় ঠিক আলোর গতিতে, অর্থাৎ সেকেন্ডে
তিনশত হাজার কিলোমিটার বেগে চলবে। পঞ্চাশ বছর পর
ফিরে এসে দেখবেন আপনার বন্ধুবান্ধব অনেকেই এই পৃথিবীতে আর নেই, অথবা খুব বৃদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আপনি
ঠিক পঞ্চাশ বছর আগের মতোই আছেন, একটুকুও বদলাননি। কারণ আলোর
গতিতে চলার ফলে সময় আপনার জন্য একদম থেমে গিয়েছিল। প্রচলিত যুক্তি
অনুসরণ করে আপেক্ষিকতত্ত্ব নির্মান করা কি সম্ভব হত?
কোয়ান্টাম ফিসিক্স-এর
সিদ্ধান্তগুলো তো রীতিমত অদ্ভুত ও অযৌক্তিক। যেমন, একটি কোয়ান্টাম কণিকা একই সময় একাধিক স্থানে অবস্থান
করতে পারে। এর অর্থ দাঁড়ায়, একজন মানুষ একই সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থান
করতে পারে। এটা কি বিশ্বাস
করার মতো কথা হল! আবার, দুটি সহজাত কণিকা পরস্পর থেকে বহু দূরে অবস্থান করেও কোনও রকম যোগাযোগ
মাধ্যম ছাড়াই পরস্পরকে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। অর্থাৎ, দু’জন সহমর্মী মানুষ যত দূরেই
অবস্থান করুক না কেন, একজনের কিছু হলে অন্যজন তৎক্ষণাৎ বুঝতে
পারে এবং প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে, কোনও রকম যোগাযোগ
মাধ্যম ব্যতিরেকেই। কোয়ান্টাম
ফিজিক্সের পরিভাষায় এর নাম ‘কোয়ান্টাম
এনট্যাঙ্গেলমেন্ট’। আধুনিক
পদার্থবিজ্ঞানের এসব অদ্ভুত কথা যুক্তিহীন মনে হওয়াই স্বাভাবিক।
প্রকৃতপক্ষে, আমাদের সচেতন মন
যুক্তিবাদী, কিন্তু আমাদের জীবনে বা চারিপাশে যা কিছু ঘটে তা
কি যুক্তিহীন নয়? আমাদের মস্তিস্ক যুক্তিবাদী, কিন্তু হৃদয় যুক্তিহীন। চিত্রকলা
যুক্তিসম্মত নয়। পিকাসো, দালি ও অন্যান্য অনেক আধুনিক চিত্রকরের সৃষ্টিতে কোনও
যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না। তেমনই
যুক্তিহীন কবিতা, গান, শিল্প। প্রকৃতপক্ষে, যৌক্তিকতা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মানুষের
স্বতঃস্ফূর্ততায়, অবাধ আবেগময়তায়, কল্পনাপ্রবণতায়,
সৃজনশীলতায়। আর সে-কারণেই
সৃজনশীল মাধ্যমগুলোতে যুক্তিহীনতার এতো প্রাধান্য। এমন কি, জাপানি জেন্ বৌদ্ধদের হাইকু (সংক্ষিপ্ত
কবিতা), উপনিষদের ঋষিদের রচনা, বাউল
সাধকদের গান অনুধাবন করলে যুক্তিহীনতার সপক্ষে যুক্তি খুঁজে পাওয়া মোটেও কঠিন হবে
না।