অমৃতের অন্বেষা ও আধ্যাত্মিক অমরতা
মানুষ চিরকালই
অমরত্বের সন্ধানে মগ্ন থেকেছে। কিন্তু সেই অমৃতরস, যা পান করে মানুষ অমর হতে পারে, তা কি আদৌ কোথাও
পাওয়া গেছে? প্রকৃতপক্ষে, মানুষের অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা তার অস্তিত্বের
স্ববিরোধী বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন।
মানুষের টিকে
থাকা ও অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা
পৃথিবীতে
মানুষের টিকে থাকার কথা ছিল না বললেই চলে। জন্মের সময় মানুষ অসহায় শিশু; পিতা-মাতার
স্নেহ-সুরক্ষা ছাড়া তার বাঁচা সম্ভব নয়। পশুদের মতো মানুষের দেহে নেই শক্ত
বহিরাবরণ, পশম বা আঁশ, যা তাকে
প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করতে পারে। পূর্ণবয়স্ক মানুষও বাঘ বা সিংহের মতো
দ্রুতগতিতে দৌড়াতে পারে না, তার দাঁত-নখও যথেষ্ট প্রতিরক্ষামূলক নয়। তবু
মানুষ টিকে গেছে এবং বিকশিত হয়েছে তার বুদ্ধিমত্তার জন্য।
মানুষের
বুদ্ধিমত্তার জোরেই অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিয়েছে। তবে বিজ্ঞান দেখিয়েছে, এ আকাঙ্ক্ষা
কেবল কল্পনারই রূপ। ফিলাডেলফিয়ার বিজ্ঞানী লেওনার্দ হেইফ্লিক প্রমাণ করেছেন যে
মানুষের দেহকোষ সীমিত সংখ্যকবার বিভাজিত হতে পারে—এই সীমাকে বলা হয় ‘হেইফ্লিক লিমিট’। একসময় কোষ বিভাজন থেমে যায়
এবং কোষ মারা যায়। অথচ যদি কোষ এই সীমা অতিক্রম করে বিভাজন চালিয়ে যায়, তবে তা হয়ে ওঠে
ক্যান্সার কোষ, যা দেহকে অসুস্থ করে তোলে। তাই কোষের অমরত্বও সুস্থতার প্রতীক নয়।
মানুষের তিন
স্তরের অমরত্ব
মানুষের
অস্তিত্ব তিনটি স্তরে বিভক্ত: দেহ, মন, ও আত্মা। তাই অমরত্বও হতে পারে তিন রকমের:
1. দেহের অমরত্ব
2. মনের অমরত্ব
3. আত্মার অমরত্ব
দেহের অমরত্ব
দেহের অমরত্ব
মানে দেহ কখনও মৃত্যুবরণ করবে না। কিন্তু এটি মানুষের পক্ষে অসম্ভব, কারণ মানবজিনে
অমরত্বের কোনও গঠন নেই। দেহের কোষের পরমায়ু সীমিত, যা ‘হেইফ্লিক লিমিট’-এর দ্বারা নির্ধারিত।
সুতরাং শারীরিক অমরত্ব কেবল কল্পনা।
মনের অমরত্ব
মনের অমরত্ব
বোঝায় এমন একটি অবস্থা যেখানে নশ্বর দেহে একটি অমর মন বাস করে। এটি স্বাভাবিকভাবে
পাওয়া যায় না; এটি অর্জন করতে হয়। এমন তখনই হয়, যখন কোনও জাতিস্মর পূর্বজন্মের স্মৃতি এবং মন
নিয়ে নতুন দেহে জন্মগ্রহণ করেন। এতে শুধু দেহের পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু মনের
অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে।
আত্মার অমরত্ব
আত্মার অমরত্ব
বোঝায় আত্মার শাশ্বত অস্তিত্ব। দেহ ও মন মারা যায়, কিন্তু আত্মা থেকে যায়। আত্মা স্বর্গ বা নরকে
যায় অথবা পুনর্জন্ম লাভ করে। এটি প্রকৃতিগত, মানুষকে এর জন্য কিছু করতে হয় না। আত্মার অমরত্ব
প্রকৃতির বিধান, যা মানুষকে শাশ্বত অস্তিত্বের অনুভূতি দেয়।
আত্মতত্ত্ব ও
অমরতার উপলব্ধি
উপনিষদ অনুসারে, আত্মা চিরকালীন, অজর ও অমর। যাজ্ঞবল্কের সঙ্গে তার স্ত্রী
মৈত্রেয়ীর এক আলোচনায় এই ধারণা স্পষ্ট হয়। মৈত্রেয়ী জানতে চান, যদি পৃথিবীর
সমস্ত সম্পদ তার হয়, তবে তা কি তাকে অমর করতে পারবে? যাজ্ঞবল্ক উত্তর
দেন, তা সম্ভব নয়।
তাই মৈত্রেয়ী বলেন, “যা আমাকে অমর করতে পারবে না, তা দিয়ে আমি কী
করব?” এই উপলব্ধিতে
প্রীত হয়ে যাজ্ঞবল্ক তাকে আত্মতত্ত্বের শিক্ষা দেন।
আত্মতত্ত্ব
অনুযায়ী, আত্মা অমর, দেহ নশ্বর।
মানুষের প্রকৃত সত্তা তার আত্মা, যা জন্ম ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বে। এই জ্ঞানই মানুষকে
অমরত্বের অনুভূতি দিতে পারে।
উপসংহার
জন্ম-মৃত্যুর চক্রে বাঁধা মানুষ দেহে অমর হতে পারে না। কিন্তু আত্মার শাশ্বতত্ব উপলব্ধি করতে পারলে সে নিজেকে অমর বলে জানতে পারে। দেহের অমরত্ব বাস্তবসম্মত নয়, কিন্তু আধ্যাত্মিক অমরত্ব মানুষের চিন্তার গভীরতাকে প্রসারিত করে এবং তাকে তার চিরন্তন অস্তিত্বের অনুভূতিতে নিয়ে যায়। ▣