অমৃতের অন্বেষা ও আধ্যাত্মিক অমরতা
মানুষ চিরকাল অমর হতে চেয়েছে। কিন্তু সেই
অমৃতের সন্ধান মিলল কই যা পান করে মানুষ অমর হতে পারল!
মানুষ অমর হতে চেয়েছে, অথচ এই পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকারই কথা ছিল না। মানুষ পৃথিবীতে
আসে এক অপরিণত অসহায় শিশু হয়ে। পিতা-মাতার
ভালবাসার সুরক্ষা না পেলে মানুষ জন্মের পরই শিকারজীবী প্রাণীর খাদ্যে পরিণত হতো। বৈরী আবহাওয়া
থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তার না ছিল শামুক কচ্ছপের মতো শক্ত বহিরাবরণ, না ছিল পাখির মতো পালক, পশুর
মতো পশম, কিংবা মাছের মতো আঁশ। একজন
পূর্ণপরিণত মানুষ বাঘ বা সিংহের চেয়ে দ্রুতবেগে দৌড়াতে পারে না। মানুষের দাঁত, হাত-পায়ের নখ যথেষ্ট প্রতিরক্ষা
দিতে পারে না। তাই মানুষের অমর হওয়ার আকাংখা কোনও দিনই তেমন
অর্থপূর্ণ ছিল না।
পৃথিবীতে মানুষ টিকে গেছে শুধুই তার বুধিমত্তার কারণে। আর এই বুদ্ধির
জোরেই সে চিরকাল অমর হতে চেয়েছে। কিন্তু আশাভঙ্গ ঘটায় ফিলাডেলফিয়া’র এক তরুণ বিজ্ঞানী লেওনার্দ হেইফ্লিক। তিনি
ল্যাবরেটরিতে মানুষের ভ্রুণ কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে গিয়ে লক্ষ্য করেন, একটি কোষ প্রায় পঞ্চাশ বার বিভাজিত হওয়ার পর মারা যায়। কোনও ভাবেই এর
বেশি বিভাজিত হয় না। তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, মানুষের দেহকোষের পরমায়ু নির্দিষ্ট সীমায় বাঁধা থাকে। এই সীমা ‘হেইফ্লিক লিমিট’ নামে পরিচিত হয়। দেহকোষের
আয়ুস্কাল কোষের ডি.এন.এ. স্মৃতির অংশ। কোনও কারণে ডি.এন.এ. স্মৃতিতে
বিভ্রাট ঘটলে কোষ ভুলে যায় ‘হেইফ্লিক লিমিট’-এর কথা, ভুলে যায় কখন বিভাজন বন্ধ করে মৃত্যু বরণ
করতে হবে। আর তখন সীমাহীন বিভাজনের ফলে সীমাহীন বৃদ্ধি ঘটে কোষের — কোষ এগিয়ে যায় অমরতার দিকে। এই ধরণের
স্মৃতিভ্রষ্ট কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে বলা হয় ক্যান্সার। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, কোষের অমরতার
পরিনতি দেহের সুস্থতা নয় — অসুস্থতা।
মানুষের অস্তিত্ব তিনটি স্তরে বিভক্ত — দেহ, মন, ও আত্মা। তাই ধরে নেওয়া
যায়, মানুষের অমরতা হতে পারে তিন স্তরের — দেহের অমরতা, মনের অমরতা, এবং
আত্মার অমরতা।
তদনুসারে, দেহের অমরতার অর্থ
দেহ অবিনশ্বর — কখনও দেহের মৃত্যু হবে না। কিন্তু মানুষের
জন্য এটা অসম্ভব। কারণ মানুষের জিন বা বংশাণুতে দেহকোষের অমরতার বিধান নেই। মানুষের
দেহকোষের পরমায়ু ‘হেইফ্লিক লিমিট’
দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই শারীরিক
অমরতা লাভ করা সম্ভব নয়।
মনের অমরতা বলতে বোঝায় — নশ্বর দেহে অমর মনের অধিষ্ঠান। তবে
স্বাভাবিকভাবে মানুষ এটা পায় না, এটা অর্জন করতে হয়। এমনটা হয় যখন কোনও সাধুজনোচিত পন্ডিত ব্যক্তি
মৃত্যুর পর নতুন দেহ ধারণ করেন, এবং গত জনমের পুরাতন মন ও স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে আসেন। তিনি
পূর্বজন্মের সব কথা মনে করতে পারেন। এক্ষেত্রে শুধু তার দেহটারই পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু মনটা থাকে পূর্বজন্মের। এ ধরণের
মানুষকে বলা হয় জাতিস্মর।
আত্মার অমরতার ক্ষেত্রে দেহ ও মন মারা যায়, কিন্তু আত্মা থেকে যায়। দেহের মৃত্যুর
পর আত্মা আমাদের জানা বা বিশ্বাস মোতাবেক যা করার কথা তা করে; যেমন স্বর্গ বা নরকে যায়, অথবা
পুনরায় দেহ ধারণ করে। সাধারণত এটা নিজে থেকেই ঘটে — প্রকৃতিগতভাবে। এটা অর্জনের
জন্য মানুষকে কিছু করতে হয় না।
আত্মা অমর, দেহ মরণশীল। ইহাই প্রকৃতির
অভিপ্রায়। এই ধরণী জীবদেহের অমরত্ব ধারণ করতে সক্ষম নয়। তার
ভূসম্পত্তির পরিমান সীমিত — মৃত্যুহীন সকল
মানুষের স্থানসংকুলান এখানে সম্ভব নয় — ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো এ তরী। তাই জন্ম-মৃত্যুর পাঁকে বাঁধা মানুষের দেহ — দেহের প্রতিটি কোষ।
প্রসঙ্গক্রমে, উপনিষদের অন্যতম ঋষি যাজ্ঞবল্ক সম্পর্কে প্রচলিত একটি গল্প উল্লেখ করছি।
যাজ্ঞবল্কের দুই স্ত্রী ছিলেন — মৈত্রেয়ী ও কাত্যায়নী। আশ্রমবাস ত্যাগ করে বানপ্রস্থ গ্রহণ করিবেন স্থির করে যাজ্ঞবল্ক বললেন, ওগো মৈত্রেয়ী, এখান থেকে আমি চলে যেতে ইচ্ছুক। এখন তোমার আর কাত্যায়নীর মধ্যে বিষয়-সম্পদ ভাগ বাঁটোয়ারা করে দেই।
মৈত্রেয়ী বললেন, যদি আমার কাছে এই ... সর্বপৃথিবী বিত্তে পূর্ণ হয়, তার দ্বারা আমি অমর হতে পারব কি পারব না?
যাজ্ঞবল্ক বললেন, না।
মৈত্রেয়ী বললেন, যাতে আমি অমর হতে পারব না তা নিয়ে আমি করব কী!
মৈত্রেয়ীর কথায় প্রীত হয়ে যাজ্ঞবল্ক তাকে আত্মতত্ত্ব উপদেশ দিতে লাগলেন।
কিন্তু কী এই আত্মতত্ত্ব যা মানুষকে অমরতার উপলব্ধি দিতে পারে?