ব্লক ইউনিভার্স — এক ক্রিয়াকালহীন মহাবিশ্বের নাম
কবি বলেছেন — ‘কালস্রোতে ভেসে যায়
জীবন।’ কাল বা সময় যেন এক নদী যার স্রোত নিরন্তর বয়ে চলে
ভবিষ্যৎ থেকে বর্তমান হয়ে অতীতের দিকে। সময়ের এই
গতিময়তা আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক ও বিশ্বাসযোগ্য মনে হলেও অধিকাংশ
পদার্থবিজ্ঞানী তেমনটা মনে করেন না।
সময় গতিশীল — এই ধারণায় একটি যৌক্তিক সমস্যা আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে সময়ের গতিবেগ কত? সময় যদি গতিশীল হয়, তবে তা নিশ্চয়ই অন্য কোনও ‘টাইম রেফারেন্স’ বা ‘প্রসঙ্গ সময়’-এর সাপেক্ষে। নদী যেমন গতিশীল দুই তীরের সাপেক্ষে। কিন্তু সময়-নদীর তো কোনও তীর নেই। তবে কি সময় নিজের সাপেক্ষে প্রবাহিত হচ্ছে? সেক্ষেত্রে সময়ের গতিবেগ দাঁড়াবে — সেকেন্ড/সেকেন্ড, অর্থাৎ সময় প্রতি সেকেন্ডে এক সেকেন্ড পথ অতিক্রম করছে। এ কথার কোনও অর্থ হয় না। সময়ের গতিবেগ নির্ণয় করতে হলে চাই এক্সটার্নাল বা বহিঃস্থ কোনও ‘টাইম রেফারেন্স’। কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বের বাইরে এমন কোনও ঘড়ি নেই যার সাপেক্ষে সময়ের গতিময়তা নির্ণয় করা যায়। অতএব, সময়ের গতিময়তা যৌক্তিকভাবেই অসম্ভব। সময় নদীর জলের মতো প্রবাহিত হয় না। কোনও বস্তুকে গতিশীল বলা হয় যখন সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে সেই বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে।
সময় যদি গতিশীল না হয়ে থাকে তাহলে সময় নিশ্চয়ই স্থির — এই ভাবনা থেকে সৃষ্টি
হয়েছে সময়ের বিকল্প তত্ত্ব। এমন একটি মহাবিশ্বের কথা ভাবা হয়েছে যেখানে সময়
ভবিষ্যৎ থেকে বর্তমান হয়ে অতীতের দিকে প্রবাহিত হয় না। স্থান যেমন নিশ্চল
ল্যান্ডস্কেপে বিস্তৃত, সময়ও তেমনি স্থির টাইমস্কেপে বিস্তৃত। সেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমস্ত
ঘটনাবলী যুগপৎ অবস্থান করে স্থান ও কালের সুতোয় বোনা বিমূর্ত এক কাঠামোয়। কাঠামোটি
চতুর্মাত্রিক, অর্থাৎ এর রয়েছে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ ও কাল। মার্কিন দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমস এর
নাম দিয়েছেন ‘ব্লক ইউনিভার্স’। যেখানে সময় স্রোতের মতো প্রবাহিত হয় না; ব্লকের মতো স্থির থাকে।
যেখানে সময় টেন্সলেস, অর্থাৎ ক্রিয়াকালহীন। যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একই
সঙ্গে বিদ্যমান থাকে। আমরা যা অতীত ও ভবিষ্যৎ বলে মনে করি তা থাকে ভিন্ন ভিন্ন
স্পেস-টাইম বা স্থানকালিক অবস্থানে। তাই আমাদের কাছে অগম্য।
মনে করুন, আপনার গোটা জীবন এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত ঘটনাবলী নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়ে আছে। চলচ্চিত্রটি আপনি দেখছেন। প্লে বাটনে চাপ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্রটি চলতে শুরু করল, আর আপনাকে এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে নিয়ে যেতে থাকল। আপনি চলছেন ক-দৃশ্য থেকে খ-দৃশ্য থেকে গ-দৃশ্যে; অন্যভাবে দেখলে, আপনি চলছেন অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে। এবার আপনি চলচ্চিত্রটির মাঝামাঝি পৌঁছলেন। এতক্ষণ যে অংশটুকু দেখলেন তা কিন্তু হারিয়ে যায়নি, এখনও তা সেখানেই সেভাবেই রয়েছে। লেসার রশ্মি এই মুহূর্তে ডিস্কের অন্য একটি অংশে আলো ফেলছে কেবল। এখানে ব্যাক-প্লে বাটন নেই বলে চলচ্চিত্রের দেখা অংশটি ফিরে দেখা আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। তবে যেদিন আলোর গতির চেয়ে দ্রুততর গতিসম্পন্ন টাইম মেশিন মানুষের হাতে আসবে সেদিন তাও সম্ভব হবে।
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জার্মান লেখক হেরমান হেস তাঁর ‘সিদ্ধার্থ’ উপন্যাসে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমকালীনতার কথা বলেছেন নদীর রূপকে। বাসুদেব, একজন খেয়াতরীর মাঝি, সিদ্ধার্থকে ইঙ্গিত দেন যে, নদীর কাছে জানার মতো অনেক গুপ্ত কথা আছে। সিদ্ধার্থ, একজন আধ্যাত্মিক অন্বেষক, নদীর উপর ধ্যান করে জানলেন — নদী একই সময় সর্বত্র বর্তমান — তার উৎসে, পর্বতশিখরে, জলপ্রপাতে, জলস্রোতে, মোহনায়, সর্বত্র, এবং নদীর অতীত ও ভবিষ্যৎ বর্তমানের সঙ্গে একাকার — যুগপত বহমান।
নদী সর্বত্রই নদী। এমন নয় যে নদী গতকাল ওখানে ছিল, আজ ওখানে নেই, অথবা আজ এখানে আছে, আগামীকাল এখানে থাকবে না। নদী সদা সর্বত্র বিদ্যমান, তার উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত সর্বত্র, তার অতীত থেকে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত সর্বদা।