বিপাসনা দুঃখমুক্তির উপায়
মৃদঙ্গের ছন্দপতনের অপরাধে স্বর্গের সুরসভা
থেকে বিতাড়িত হলেন গীতনায়ক সৌরসেন ও তাঁর প্রেয়সী মধুশ্রী। ইন্দ্রদেব রাগে ফেটে
পড়ে বললেন, “যাও মর্ত্যে। সেখানে দুঃখ পাবে, দুঃখ দেবে। সেই দুঃখেই ক্ষয় হবে তোমাদের অপরাধের।” সেই থেকে মানবজাতির
কাঁধে চেপে বসেছে দুঃখের অনিবার্য ভার।
মানুষ চিরকাল দুঃখ থেকে মুক্তির পথ খুঁজে
এসেছে। সুখের সন্ধানে তার যাত্রা আজও চলমান। কিন্তু
খুব কম মানুষই প্রকৃত মুক্তি খুঁজে পায়। জীবনের ব্যস্ততা, চাহিদা, স্মৃতি, অনিশ্চয়তা — সব মিলিয়ে
কখনও কখনও জীবন হয়ে ওঠে বিরক্তিকর, ক্লান্তিকর, এমনকী অর্থহীন। অনেক সময় মনে হয় — এ জীবন যেন শুধুই দুঃখময়।
যদি বা কখনও মনে হয় দুঃখ নেই,
তখনই মন টেনে আনে কোনও পুরনো ক্ষতের স্মৃতি – কিংবা আশঙ্কা জাগায় ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বেদনার কথা।
আমরা দুঃখ ভুলে থাকতে চাই, অথচ দুঃখ আমাদের মনে স্থান করে নেয় একটি ঘটনার স্মৃতিতে, একটি কথার ছায়ায়, কিংবা ভবিষ্যতের এক দুর্বোধ্য আশঙ্কায়।
দুঃখ প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে অনুভূত হয়, কিন্তু মানুষের মন সামাজিক। সে নিজের যন্ত্রণা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চায়। এভাবেই একটি নিভৃত বেদনা এক সময় ছড়িয়ে পড়ে সমাজে — সৃষ্টি হয় সামাজিক দুঃখবোধ। এইভাবে ব্যক্তিগত যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ে বৃহত্তর মানবসমাজে, হয়ে ওঠে এক সম্মিলিত বেদনার প্রতিচ্ছবি।
দুঃখ এই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ — কারণ যা
আমরা চাই, তা সবসময় ঘটে না; বরং যা চাই না, সেটাই ঘটে। এই পরস্পরবিরোধী বাস্তবতার গভীরে দুঃখের জন্ম হয়।
তবে আড়াই হাজার বছর আগে, এক রাজকুমার ঠিক করলেন তিনি এই দুঃখের গোড়া খুঁজে বের
করবেন। তিনি হলেন গৌতম বুদ্ধ।
তিনি বুঝতে পারেন, দুঃখের মূল উৎস নিহিত আমাদের মনেই — চেতনার গভীর প্রদেশে।
প্রত্যাশা থেকে জন্ম নেয় বিশ্বাস, আর বিশ্বাস গড়ে তোলে আশার কাঠামো। কিন্তু কঠোর বাস্তবতা যখন সেই বিশ্বাসকে আঘাত
করে, তখন মন ভেঙে পড়ে বেদনায়। সেই বেদনা সঞ্চিত হয় স্মৃতির গভীরে, তৈরি করে এক জটিল অভ্যন্তরীণ জাল — যেখানে প্রতিটি স্মৃতি নতুন দুঃখের
সূত্র হয়ে ওঠে।
আমাদের মন কখনও বর্তমান মুহূর্তে থাকে না। তা ছুটে চলে অতীতের দিকে — যেখানে রয়েছে
বেদনার স্মৃতি, কিংবা ভবিষ্যতের দিকে — যেখানে রয়েছে সেই
বেদনার পুনরাবৃত্তির ভয়। ফলে আমরা প্রতিনিয়ত নতুন করে দুঃখ অনুভব করি, এমনকী তখনও, যখন দুঃখের বাস্তব কারণ অনুপস্থিত।
এই দুঃখ থেকে পালানোর চেষ্টা বৃথা। মনকে দমন
করা যায় না; তাতে দুঃখ আরও প্রবল হয়ে ওঠে। তবে গৌতম বুদ্ধ এক বিকল্প পথ দেখিয়েছেন —
লড়াই নয়, পালানো নয়, বরং নিরীক্ষণ।
![]() |
গৌতম বুদ্ধ |
দুঃখদায়ক চিন্তা এলে তাকে শুধু চুপচাপ দেখা — কোনও প্রতিক্রিয়া ছাড়া। নয় বিচার, নয় প্রতিরোধ, নয় দোষারোপ — শুধু আত্মস্থ নিরীক্ষণ। এই ‘দেখা’-র মধ্যেই নিহিত আছে গভীর রূপান্তরের সম্ভাবনা। চিন্তা আসে, আবার সরে যায়। মন আর তাকে আঁকড়ে ধরে না। এই পদ্ধতির নাম বিপাসনা ভাবনা, যা আজ বিশ্বব্যাপী পরিচিত Vipassana Meditation নামে।
বিপাসনা আমাদের শেখায় — মন যখন নিরীক্ষকের
ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন তা আর দুঃখের শিকার থাকে না। এই ‘দেখা’ মানে নিঃশব্দ মনোযোগ, গভীর পর্যবেক্ষণ, প্রত্যেক মুহূর্তে বর্তমান থাকা।
প্রথমে শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হয় — শুধু দেখলেই
কি দুঃখবোধ মিলিয়ে যায়? গৌতম বুদ্ধ বলেন, “যেখানে আলো জ্বলে, সেখানে চোর প্রবেশ করে না।” তেমনি, যেখানে ‘সচেতনতা’র আলো
জ্বলে, সেখানে প্রবেশ করতে পারে না দুঃখের অন্ধকার। তাঁর মতে, দুঃখবোধ থেকে
মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রয়োজন শুধু চিন্তাগুলিকে ‘দেখা’।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দুঃখ আসে মূলত অতীত ও
ভবিষ্যতের চিন্তা থেকে। কিন্তু বর্তমান — এই একমাত্র মুহূর্তটি —
প্রায়শই থাকে নিরপেক্ষ, শান্ত, মুক্ত। বিপাসনা সেই বর্তমানেই মনকে নোঙর করার
প্রশিক্ষণ দেয়। বর্তমান মূহুর্তেই লুকিয়ে
আছে শান্তির চাবিকাঠি।
বিপাসনা শুধু ধ্যান নয় — এটি এক জীবনদর্শন, যেখানে ‘চেতনা’ হয় আশ্রয়, এবং ‘নিরীক্ষণ’ হয়
মুক্তির পথ। নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে এই পথেই সম্ভব এক
গভীর রূপান্তর — যেখানে জীবন একই থাকে, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। তখন দুঃখ আসে, কিন্তু মন তাকে ধরে রাখে না। তখন জীবন হয় হালকা, প্রশান্ত, এবং অন্তর্লোকপ্রসূ।