একটি খড়ে বিপ্লব ও প্রাকৃতিক কৃষি

একদিন না-চষা জমিতে শুধু বীজ ছিটিয়ে ফসল ফলানোর মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল আজকের কৃষি তার পর অতিক্রান্ত হয়েছে প্রায় বারো হাজার বছর ইতিমধ্যে জনসংখ্যা বেড়েছে জ্যামিতিক হারে আনুপাতিক হারে বেড়েছে খাদ্যের চাহিদা সে দিনের সেই কৃষিপদ্ধতি অনুসরণ করে ক্রমবর্ধমান এই চাহিদা মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না তাই কৃষিপদ্ধতির ঘটেছে আমূল পরিবর্তন

আজ মানুষ ব্যবহার করছে উচ্চফলনশীল জাতের বীজ গভীর চাষ দিয়ে ভাঙছে মাটি উচ্চমাত্রায় প্রয়োগ করছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বিষ ফলে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার বছরের বিবর্তনের ধারায় প্রতিষ্ঠিত দেশীয় আবহাওয়ার উপযোগী শস্যের জাত বিনষ্ট হচ্ছে মাটির তেজ — উর্বরাশক্তি কলুষিত হচ্ছে পরিবেশ

আধুনিক বিজ্ঞানের অবদান সর্বনাশা এই কৃষিপদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন জাপানি দার্শনিক ও কৃষিবিদ মাসানবু ফুকুওকা তিনি ঘোষণা করলেন, প্রকৃতিকে জয় করে বা ধ্বংস করে নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে সহযোগিতা করেই আমাদেরকে টিকে থাকার কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে তাই তিনি শোনালেন প্রাকৃতিক কৃষির কথা

Masanobu Fukuoka

মাসানবুর প্রাকৃতিক কৃষিব্যবস্থা চারটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত প্রথমত, জমি চাষ না করা কারণ গাছের মূলের মৃত্তিকা-বিদারণ, কেঁচো, ইঁদুর প্রভৃতি ক্ষুদ্র প্রাণীর চলাচল এবং বিভিন্ন জীবাণুর কর্মকান্ডের ফলে মাটি প্রাকৃতিক পদ্ধতিতেই কর্ষিত হয়ে থাকে

দ্বিতীয়ত, রাসায়নিক সার বা তৈরি কম্পোস্ট ব্যবহার না করা মাটিতে পড়ে থাকা গাছ ও প্রাণীর জৈব অবশেষ বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের কর্মকান্ডের ফলে পচে গিয়ে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করে থাকে সে জন্য জমিতে সবুজ সার ও খড়ের আচ্ছাদন রাখাই যথেষ্ট

তৃতীয়ত, নিড়ানি বা আগাছানাশক বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে আগাছা দমন না করা ফুকুওকা মনে করেন আগাছা ধ্বংস নয়, নিয়ন্ত্রণ করা উচিত কারণ আগাছা মাটির উর্বরতা ও জৈবসমাজের ভারসাম্য রক্ষা করে তিনি জমিতে খড়ের আচ্ছাদন, এবং সাথি ফসল হিসাবে সাদা ক্লোভার নামক উদ্ভিদের ছাউনি দিয়ে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন

চতুর্থত, কীটনাশক বিষের উপর নির্ভরশীল না হওয়া ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও গাছের রোগবালাই সব সময়ই থাকে, কিন্তু প্রকৃতিতে তা কখনই তেমন পর্যায়ে সংঘটিত হয় না যে, রাসায়নিক বিষ প্রয়োগ করতে হবে

দক্ষিণ জাপানের ছোট্ট দ্বীপ শিকোকুতে অবস্থিত মাসানবু ফুকুওকার ন্যাচারেল ফার্মিং বা প্রাকৃতিক কৃষির গবেষণাগার সেখানে তিনি সারা বছর ক্লোভার ও আগাছায় ভরা মাঠে সফলভাবে আবাদ করে থাকেন ধান, যব বা রাই

অক্টোবর মাসের প্রথমদিকে যে মাঠে ধান কয়েক সপ্তাহ পর কাটার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে তিনি সাদা ক্লোভার ও শীতকালীন শস্যের (যব বা রাই) দ্রুতবর্ধনশীল জাতের বীজ ছিটিয়ে দেন যখন ধান কাটার সময় হয় তখন ক্লোভার, রাই বা যবের চারা গজিয়ে ৩-৪ সেন্টিমিটার বড় হয় ধান কাটা ও মাড়াইয়ের পর ধানের সমস্ত খড় সেই মাঠ জুড়ে বিছিয়ে দেন এরপর নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে কচি রাই বা যবে পূর্ণ মাঠে ধানের বীজ ছিটিয়ে দেন এই সময় সামান্য হাঁস-মুরগির মল সারা মাঠে ছড়িয়ে দেন এতে খড়ে পচন ত্বরান্বিত হয়

মাসানবু এইভাবে সারা বছরের বোনার কাজ নববর্ষের আগেই শেষ করে থাকেন ধানের বীজ বসন্তকাল পর্যন্ত মাটিতে সুপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকে মে মাসে শীতের শস্য কাটা হয় শস্য মাড়াইয়ের পর সমস্ত খড় আবার সেই মাঠে ছিটিয়ে দেন এরপর তিনি সেচ দিয়ে জমি কয়েক দিনের জন্য পানিতে ডুবিয়ে রাখেন এতে ক্লোভার ও অন্যান্য আগাছা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে তখন ধানের অঙ্কুর উদগত হয়ে খড়ের আবরণ ভেদ করে উপরে চলে আসে আগস্ট মাসে তিনি আবার সেচ দেন, কিন্তু জমিতে পানি ধরে রাখেন না

প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ধান ও শীতকালীন শস্য আবাদের বর্ষ-চক্র এই ভাবে সম্পন্ন হয় মাসানবুর জমিতে এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে তিনি সিকি একরে ধান ফলাচ্ছেন ৫০০-৬০০ কিলোগ্রাম, অর্থাৎ গড়ে হেক্টরপ্রতি ৫ টন ধানের এই ফলন ওই এলাকায় রাসায়নিক পদ্ধতিতে উৎপন্ন ফলনের কাছাকাছি এবং প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে প্রাপ্ত শীতকালীন শস্যের ফলন প্রায়শই রাসায়নিক পদ্ধতিতে প্রাপ্ত ফলনের চেয়ে বেশি

খুবই অনাড়ম্বর ও সহজসাধ্য মাসানবুর কৃষিপদ্ধতি; বীজ ছিটানো আর খড় বিছানো আপাতদৃষ্টিতে গুরুত্বহীন মনে হলেও তাঁর কৃষিব্যবস্থার মূল ভিত্তিই হচ্ছে এই খড়ের ব্যবহার এর সঙ্গে জড়িত মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, আগাছা নিয়ন্ত্রণ, পাখির উপদ্রব মোকাবিলা এবং মাটির রস সংরক্ষণ

মাসানবুর প্রাকৃতিক কৃষিব্যবস্থায় খড় রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসাবে বিবেচিত হয় বসন্তে বা শীতে জমিতে খড় বিছিয়ে তার ওপর সামান্য হাঁস-মুরগির মল হালকাভাবে ছিটিয়ে দিলে মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই খড় সম্পূর্ণ পচে গিয়ে গাছের উপযোগী খাদ্য সরবরাহ করতে পারে

মাঠের একটি ফসল দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আর একটি ফসলের বীজ ছিটানো এবং পাকা ফসল কাটার পর খড় বিছিয়ে জমি ঢেকে দেওয়ার ফলে বীজের জন্য আড়াল তৈরি হয় তাতে বীজ পাখির উপদ্রব থেকে রক্ষা পায় তা ছাড়া খড়ের আচ্ছাদন মাটির রস সংরক্ষণ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে

খড়ের ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল প্রাকৃতিক কৃষিব্যবস্থাকে মাসানবু একটি আন্দোলন হিসাবে উপস্থাপন করেছেন তিনি এই আন্দোলনের নাম দিয়েছেন ‘ওয়ান-স্ট্র রেভলুশন’ বা ‘একটি-খড়ে বিপ্লব’ এই নামে তাঁর একটি বই প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে বইটি সারা বিশ্বে কৃষি ও মানুষের চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলে

মাসানবু মনে করেন, তাঁর আন্দোলনের অন্যতম প্রতিবন্ধক হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞানের স্পেশালাইজেশন বা জ্ঞানের খন্ডিতকরণ এর ফলে বিনষ্ট হচ্ছে মানুষের দৃষ্টির সমগ্রতা আর সমগ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে যা দেখা হয় তা প্রকৃত দেখা নয়; অন্ধের হস্তি দর্শনের মতই অসম্পূর্ণ তাই তাঁর মতে একজন বিজ্ঞানীকে বিজ্ঞানী হওয়ার আগে দার্শনিক হওয়া প্রয়োজন

তবু প্রচন্ড রকম আশাবাদী মাসানবু তাঁর বিশ্বাস, রাসায়নিক কৃষি এক দিন অবশ্যই ব্যর্থ হবে আজ একটি খড় যত হালকা ও তুচ্ছ মনে হোক না কেন, একদিন এর ওজন ও গুরুত্ত্ব মানুষ উপলব্ধি করবে সেই দিন শুরু হবে এক নতুন বিপ্লব প্রতিষ্ঠিত হবে প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সহযোগিতার নতুন আদর্শ — নতুন মূল্যবোধ। 

তথ্যসূত্র: The One-Straw Revolution: An Introduction to Natural Farming. Author: Masanobu Fukuoka; Publisher: Rodale Press, USA; 1978.

প্রথম প্রকাশ: দৈনিক পত্রিকা ‘সংবাদ’; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি; ৮ জানুয়ারি, ১৯৯১

অসীম দে
গুয়েল্ফঅন্টারিওকানাডা

Popular posts from this blog

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চেনার উপায়

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা — চন্দ্রসূর্যের মিলন ও বিরহ তিথি

তেল মাহাত্ম্য

ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ

রাসলীলা মাহাত্ম্য

আঁধারের রূপ ও বিপন্ন অন্ধকার

আধ্যাত্মিকতা — পাশ্চাত্য ভাবধারার আলোকে

সূর্য উপাসনা

হৃদয়-দর্পনে দেখা