মাটির দারিদ্র
মাটি প্রাকৃতিক পরিবেশের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং সমস্ত পার্থিব প্রাণের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। মাটি ছাড়া প্রাণ হয় না, প্রাণ ছাড়া মাটি হয় না। মাটি ও প্রাণ একই সঙ্গে উদ্ভুত হয়েছে।
পৃথিবীতে প্রায় সকল প্রাণের অস্তিত্ব
নির্ভর করে মূলত মাটির উপর। আর মাটির
প্রাণ-প্রতিপালন ক্ষমতা নির্ভর করে মাটির সুস্বাস্থ্যের উপর। সুস্থ মাটি
নির্ধারণ করে গাছপালার স্বাস্থ্য, গাছপালার স্বাস্থ্য নির্ধারণ করে জীবজন্তুর
স্বাস্থ্য, যা নির্ধারণ করে মানুষ তথা সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য।
প্রকৃতপক্ষে, ভূত্বকের উপরাংশের উর্বর
মাটির পাতলা স্তর দ্বারাই পৃথিবীতে প্রতিপালিত হয় জীবন। কিন্তু অবিবেচক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করায় ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে মাটির উর্বরতা। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায়
পরিচালিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, নিবিড় চাষাবাদের কারণে প্রতি বছর ২৪ বিলিয়ন টন
উর্বর মাটি হারিয়ে যাচ্ছে। যদি উর্বরতা
হ্রাসের এই ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে ৬০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত উপরিস্তরের মাটি
(টপ সয়েল) অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়বে।
মাটির উর্বরতা হ্রাসের বড় কারণ মাটিতে জৈবপদার্থের পরিমান হ্রাস পাওয়া। আর জৈবপদার্থ হ্রাস পাওয়ার বড় কারণ উদ্ভিদের দেহাবশেষ অর্থাৎ শস্যের খড় মাটিতে ফিরিয়ে না দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমরা মাটি থেকে উৎপন্ন আমাদের যা-কিছু প্রয়োজনীয় পদার্থ যে পরিমানে লাভ করছি মাটিকে সে পরিমান ফিরিয়ে না দিয়ে তাকে দরিদ্র করে দিচ্ছি’।† তিনি বলতে চেয়েছেন — মাটি যে শিকড়, খড় ও শস্য-দানা উৎপাদন করে সেখান থেকে শস্য-দানা রেখে শিকড় ও খড় মাটিকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।
রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন, ‘গাছপালা জীবজন্তু প্রকৃতির কাছ থেকে যে সম্পদ পাচ্ছে তা তারা ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মানুষকে নিয়ে। মানুষ তার ও প্রকৃতির মাঝখানে আর-একটি জগৎ সৃষ্টি করেছে যাতে প্রকৃতির সঙ্গে তার আদান ও প্রদানের যোগ-প্রতিযোগে বিঘ্ন ঘটছে’।† প্রকৃতিতে সবকিছুই দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্কে বাঁধা। যেসব রাসায়নিক মৌল উপাদান দিয়ে উদ্ভিদের দেহ গঠিত হয় সেসব মৌল উপাদান উদ্ভিদ মাটি ও পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করে। মৃত্যুর পর উদ্ভিদ দেহাবশেষের মাধ্যমে (পাতা, খড়, শিকড়) সেই মৌলিক উপাদানগুলিকে মাটিতে ফিরিয়ে দেয়। কখনও কখনও উদ্ভিদ সরাসরি মাটিতে ফিরিয়ে দেয় না, বরং তৃণভোজী প্রাণীরা উদ্ভিদকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে এবং মাটিকে ফিরিয়ে দেয় গোবর। এই ভাবে চক্রাকার পথে আবর্তিত হয় গাছপালার জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক মৌলগুলি। কিন্তু মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কাজকর্ম, যেমন ফসলের ক্ষেত থেকে খড় ও গোবর সরিয়ে নেওয়ার ফলে পুষ্টি চক্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে চলেছে।
মাটি কী? মাটি হচ্ছে খনিজ পদার্থ,
জৈবপদার্থ, জল ও বাতাসের মিশ্রণ। এই চারটি উপকরণ
বিস্ময়করভাবে পরস্পর বিক্রিয়া করে মাটিকে প্রাণবন্ত রাখে। মাটি পৃথিবীর
সব চেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। এই সম্পদ
নবায়নযোগ্য। তবে মাটির
নবায়ন ঘটে অত্যন্ত ধীর গতিতে। প্রকৃতপক্ষে,
এক ইঞ্চি উপরিস্তরের মাটি (অধিমৃৎ)সৃষ্টি হতে কয়েকশো বছর লেগে যেতে পারে।
মাটিতে খনিজ পদার্থের কণা সাধারণত বালি,
পলি, কাদা আকারে থাকে। এরা সৃষ্টি হয় শিলা ক্ষয়ের ফলে। খনিজ পদার্থের মধ্যে থাকে গাছের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান — ফসফরাস,
পটাসিয়াম, সালফার, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, বোরন, দস্তা, মলিবডেনাম,
নিকেল, তামা, কোবাল্ট ও ক্লোরিন। কিন্তু গাছের বৃদ্ধির জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন খনিজ হিসাবে
পাওয়া যায় না। মাটিতে নাইট্রোজেন আসে জৈবপদার্থ থেকে।
জৈবপদার্থ মানে জীবজাত পদার্থ। মাটিতে জৈবপদার্থের প্রাথমিক উৎস উদ্ভিদের
কোষকলা। অরণ্যে ঝরে পড়া
পাতা, শস্য খেতে পড়ে থাকা খড়, শিকড় ইত্যাদি পচনের ফলে তৈরি হয় জৈবপদার্থ। জৈবপদার্থে থাকে তিন ধরণের জৈব উপাদান:
১) উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ এবং জীবিত জীবাণু, ২) আধা-পচা জৈবপদার্থ, ৩) পরিণত
জৈবপদার্থ বা হিউমাস। জীবিত জীবাণু উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ এবং পূর্বের আধা-পচা জৈবপদার্থের ভাঙ্গন
বা পচানোতে সাহায্য করে। পচনের ফলে মুক্ত হয় গাছপালার ব্যবহারযোগ্য নাইট্রোজেন এবং অন্যান্য পুষ্টি
উপাদান।
জৈবপদার্থ হচ্ছে মাটির সুস্বাস্থ্যের
প্রধান নির্ধারক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, মাটির উপরের ২০-সেন্টিমিটার স্তরে ৩ থেকে ৬ শতাংশ
জৈব উপাদান থাকা আবশ্যক। জৈব পদার্থের এই পরিমান মাটিতে জল ধরে রাখা এবং মাটির ক্ষয় রোধ করার
জন্যও আবশ্যক।
মাটির মধ্যে যে পরিণত জৈবপদার্থ থাকে
তাকে ল্যাটিন ভাষায় বলে ‘হিউমাস’। এই হিউমাস থেকে
এসেছে ‘হিউম্যান’ অর্থাৎ মানুষ। মানুষের দেহগঠন এবং জীবনধারণের জন্য যে পুষ্টির প্রয়োজন হয় তা আসে এই
হিউমাস মাটিতে উৎপন্ন ফসল থেকে। সুতরাং বলা যেতেই পারে — মানুষ হিউমাস মাটির তৈরি। এবং মৃত্যুর পর মানুষ আবার হিউমাস হয়। মাটি আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সংযোজক। মাটি আমাদের উৎস ও গন্তব্যকে সংযুক্ত করে।
জড় পদার্থ মনে হলেও মাটি আসলে প্রাণে
পরিপূর্ণ এক জীবন্ত সত্তা। এক চা-চামচ
মাটিতে প্রায় একশো কোটি জীবাণু বাস করে। এই জীবানুদের প্রধান খাবার কার্বন। কিন্তু তারা
উদ্ভিদের মতো বাতাস থেকে কার্বন গ্রহণ করতে পারে না। তারা মাটিতে উদ্ভিদাদি পচিয়ে কার্বন আহরণ করে। আর উপজাতক হিসাবে জৈবপদার্থ সৃষ্টি করে। জীবাণু না থাকলে মাটিতে জৈবপদার্থ সৃষ্টি হবে না। মাটি হারাবে উর্বরতা, হারাবে উৎপাদন ক্ষমতা। মাটির জীবাণু বৈচিত্র্য কৃষি উৎপাদন তথা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মাটিতে জৈবপদার্থের মজুদ অফুরন্ত নয়। নানাভাবে এর পরিমান ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যায়। যখন লাঙল দিয়ে চাষ করে মাটি ভেঙে দেওয়া হয় তখন অক্সিডেসন বা জারণের
ফলে মাটির কিছু জৈবপদার্থ হারিয়ে যায়। তাছাড়া, ফসল কাটার পর যখন শস্যের খড় জমি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং আর কখনও
ফেরত আনা হয় না, তখন খড়ের সঙ্গে বেশ কিছু পুষ্টি উপাদানও হারিয়ে যায়। ফলে, অতীতে বন্য গাছপালার দ্বারা গড়ে
উঠা জৈবপদার্থের মজুদ নিঃশেষ হতে থাকে।
বাংলাদেশে চালানো এক সাম্প্রতিক
গবেষণায় দেখা গেছে যে, দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষি জমির জৈব উপাদান কমে গেছে, যার
ফলে ফসল উৎপাদনে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হচ্ছে। এই গবেষণায় বলা হয়েছে, ফসলি জমিতে যেখানে ৫ শতাংশ জৈব উপাদান থাকা
দরকার সেখানে দেশের বেশিরভাগ কৃষি জমিতে জৈব উপাদান দুই শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। (সূত্র: বিবিসি বাংলা, ঢাকা; ২৩ ডিসেম্বর ২০২১)।
জমিতে জৈবপদার্থ কমে যাওয়ায় কমে যায়
শস্যের জন্য অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান। সেই অভাব পূরণ
করতে প্রয়োগ করা হয় নাইট্রোজেন-ফসফরাস-পটাসিয়াম ভিত্তিক রাসায়নিক সার। কিন্তু মাটিতে জৈবপদার্থ সৃষ্টিকারী
জীবাণুর খাদ্য কার্বনের অভাব পূরণ করার বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়। মনে করা হয়, যেহেতু গাছ মাটি থেকে
কার্বন গ্রহণ করে না, বাতাস থেকে করে, তাই মাটিতে কার্বন যোগ করার প্রয়োজন নেই। এটি ছিল একটি ভুল বিবেচনা। এই রেওয়াজ চলে আসছে বিংশ শতাব্দীর
প্রথম থেকে।
কার্বন মাটির সুস্থতার নিয়ামক। সুস্থ মাটিতে জৈব কার্বনের পরিমান
অধিক থাকে এবং সেখানে বহু বিচিত্র ধরণের জীবাণু বাস করে। জৈব কার্বন মাটির জীবাণুদের খাদ্য। জীবানুরা বাতাস থেকে কার্বন গ্রহণ করতে পারে না। তারা কার্বন
আহরণ করে খড় ও উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ থেকে। সুতরাং মাটিতে যদি খড় ও উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ প্রায়ই যোগ করা না হয় তা
হলে মাটির জীবাণুরা অনাহারে থাকে এবং পরিণামে মাটি মরে যায়। মরে যায় মানে মাটিতে যথেষ্ট জীবন্ত জীবাণু আর থাকে না যারা জৈব-ভূরসায়ন
প্রক্রিয়ায় শস্যের সুস্থ বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।
সুতরাং মাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে
মাটিতে কার্বন তথা জৈব উপাদান যোগ করতে হবে। কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে মাটির উর্বরতা পুনরুদ্ধার করতে হবে। জৈব ও অজৈব সারের সমন্বিত বিচক্ষণ
ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
পুনরুদ্ধারমূলক কৃষির প্রবক্তা,
‘ওয়ার্ল্ড ফুড পুরস্কার-২০২০’ বিজেতা মৃত্তিকাবিজ্ঞানী প্রফেসর রত্তন লাল (Rattan
Lal) বলেছেন, ‘আমরা কৃষি জমি ৩০ শতাংশ কমিয়ে এবং মোট সারের ব্যবহার অর্ধেক কমিয়েও
২১০০-এর মধ্যে ফসল উৎপাদন দ্বিগুণ করতে পারি যদি মাটির উর্বরতা উন্নত করতে পারি।’ অর্থাৎ, ক্রমবর্ধমান মানবজাতির খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করার টেকসই পথ
হচ্ছে মাটিতে জৈবপদার্থের পরিমান বৃদ্ধি তথা মাটির উর্বরতা পুনরুদ্ধার করা।
উপসংহারে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করছি — ‘মানুষ প্রাণের উপকরণ যদি মাটিকে ফিরিয়ে দেয় তবেই মাটির সঙ্গে তার প্রাণের কারবার ঠিকমত চলে, তাকে ফাঁকি দিতে গেলেই নিজেকে ফাঁকি দেওয়া হয়। মাটির খাতায় যখন দীর্ঘকাল কেবল খরচের অঙ্কই দেখি আর জমার বড়ো-একটা দেখতে পাই নে তখন বুঝতে পারি দেউলে হতে আর বড়ো বেশি বাকি নেই’।† ▣
† রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর > অভিভাষণ — বিশ্বভারতী সম্মিলনী > পল্লীপ্রকৃতি