স্বর্গ নরক
মানুষের চিরকালের জিজ্ঞাসা — মৃত্যুর পরে আমার কী হবে? জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ার বলেছেন, ‘মৃত্যুর পরে তুমি তা-ই হবে যা ছিলে তোমার জন্মের আগে’। জন্মের আগে যদি প্রকৃতির অংশ হয়ে থাকি তাহলে মৃত্যুর পরে তা-ই হব। কারণ আমাদের দেহের সমস্ত নির্মাণ সামগ্রী আসে প্রকৃতি থেকে এবং মৃত্যুর পরে তা প্রকৃতিতে ফেরত যায়।
আমাদের দেহ
পৃথিবীর দান। তাই
পৃথিবীতে ফেরত যায়। কিন্তু
আমাদের চৈতন্য বা আত্মা স্বর্গলোকের ধন। সুতরাং মৃত্যুর পরে সকল আত্মা স্বর্গে
ফেরত যাবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী
শুধু পুণ্যবান আত্মাই স্বর্গে যাবে, যে-কোনও আত্মা নয়।
যে-মুহূর্তে
তুমি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবে এবং তোমার আত্মা দেহ থেকে বের হয়ে যাবে, তোমার শরীর মরে যাবে। আর তোমার আত্মা কর্মফল অনুযায়ী স্বর্গ কিংবা
নরকে যাবে। এমনটাই
ধর্মশাস্ত্রের বিধান। লক্ষণীয়, বলা হচ্ছে — বিচার হবে কৃতকর্মের নিরিখে, ধর্মবিশ্বাসের
নিরিখে নয়।
স্বর্গ ও নরক |
আমার আত্মা কত দিন স্বর্গে কিংবা নরকে থাকবে? বলা হয়, অনন্তকাল। অনন্তকাল স্বর্গবাস সম্ভব হতে পারে নিজেকে দেবতায় রুপান্তরিত করতে পারলে। অন্যথায় পৃথিবীতে এমন কী পুণ্যের কাজ আছে যা করলে অনন্তকাল স্বর্গসুখ ভোগের অধিকার মিলবে?
অনন্তকাল
নরকবাস? পৃথিবীতে কী এমন পাপকাজ আছে যা করলে অনন্তকাল নরকে শাস্তিভোগ করতে হবে? একটা মানুষের পক্ষে কত পাপ করা সম্ভব? একটা মানুষ সারা
জীবনে যত অপরাধ করতে পারে যে-কোনও দেশের দন্ডবিধিতে তার শাস্তির মেয়াদ কখনই
অনন্তকাল হতে পারে না।
ভিন্ন ভাবনাও
আছে। এমনও
বলা হয় যে, স্বর্গ বা নরকে আমাদের আত্মা পুনর্জীবনের জন্য
অপেক্ষা করে। যারা স্বর্গে থাকে তাদের আগে পুনর্জনম হয়। আর যারা নরকে থাকে তাদের প্রথমে
যন্ত্রণা ভোগের মাধ্যমে পাপক্ষালন করতে হয়, তারপরে তাদের পুনর্জনম
হয়।
এই ভাবনায়
স্বর্গবাস অনন্ত কালের নয়। এমনকী বিনামূল্যেও নয়। সঞ্চিত পুণ্য খরচ করে স্বর্গে থাকতে
হয়।
পুণ্যের সঞ্চয় শেষ হলে স্বর্গ ছেড়ে দিতে হয়। এমনই এক অসাধারণ দৃশ্যকল্পের অবতারণা
করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ (চিত্রা)
কবিতায় —
‘ম্লান হয়ে এল কন্ঠে মন্দারমালিকা,
... পুণ্যবল হল ক্ষীণ, আজি মোর স্বর্গ হতে
বিদায়ের দিন। ... মুহূর্তে
খসিয়া পড়ি দেবলোক হতে, ধরিত্রীর অন্তহীন
জন্মমৃত্যুস্রোতে।’
এমন কথাও বলা হয় যে, স্বর্গ ও নরকের
অবস্থান বাইরে দূরে কোথাও নয়, মানুষের মনের ভিতরে। এবং একমাত্র মনই পারে মানুষের বিচার করতে, বাইরের কেউ নয়। মৃত্যুর পরে শেষ বিচারের দিনে প্রত্যেক মানুষকে তার নিজের মনের মুখোমুখি
হতে হবে। যদি শরীরী জীবনে কেউ স্নেহ, প্রীতি, করুণা, বিচক্ষণতা, সমবেদনা, ইত্যাদি
অনুভূতির চর্চা করে থাকেন, তা হলে পরবর্তী পুনর্জনমের আগ অব্দি তাঁর আত্মা শান্তিতে
থাকবে।
পক্ষান্তরে, কেউ যদি শরীরী জীবনে কেবল
মন্দ অনুভূতি যেমন ক্রোধ, হিংসা, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা, অসন্তোষ চর্চা করে থাকেন তাহলে
ওই অনুভূতিগুলি একত্রিত হয়ে তাকে ভূতপ্রেতের মতো ধাওয়া করবে। এবং সেই অভিজ্ঞতা হবে নরকযন্ত্রণার মতো দুঃসহ।
অর্থাৎ, মানুষের শেষ বিচার হবে নিজের
চেতনা, বিবেক বা মনের আদালতে। এবং যত দিন
নতুন পুনর্জনমের প্রয়োজন দেখা না দিবে তত দিন অশরীরী আত্মা স্বর্গের শান্তি কিংবা
নরকের যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকবে। আর জীবিত প্রিয়জনেরা তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করবে।
অর্থাৎ, স্বর্গ ও নরকের অবস্থান
মানুষেরই মধ্যে। অবিবেকী কর্মের জন্য মানুষ আত্মগ্লানির নরক-অনলে দগ্ধ হবে। এবং পরস্পরের সঙ্গে প্রীতিপূর্ণ
সম্পর্কের কারণে মানুষ স্বর্গের সুখ উপভোগ করবে।
অতএব, দেশ বা সংস্কৃতি যা-ই হোক না
কেন, প্রত্যেক ধর্মের মর্মবাণী একই রকম। সব ধর্মই বলে যে, প্রত্যেক মানুষকে তার কর্ম, চিন্তা, এবং আকাঙ্খার ফল
ভোগ করতে হবে। এবং কেবল প্রীতি
ও বিবেকের চর্চার পথেই শান্তি লাভ করা সম্ভব হবে, কি বাস্তব জীবনে কি মৃত্যুর পরের
জীবনে।
স্বর্গ কোনও ভৌগলিক ধারণা নয়,
মনস্তাত্ত্বিক। মানুষের মনই সেই জগৎ যেখানে স্বর্গকে নরক এবং নরককে স্বর্গে
রূপান্তরিত করা সম্ভব। স্বর্গ কিংবা নরকের জন্য মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। উভয়ই বিদ্যমান বর্তমানে। যখন আমরা কোনও রকম প্রত্যাশা, হিসাবনিকাশ, আপোশ-মীমাংসা ছাড়াই ভালবাসতে
পারি, তখন আমরা আসলে স্বর্গে থাকি। আর যখন আমরা ঝগড়া করি, ঘৃণা করি, তখন আমরা নরকে থাকি।