রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা
একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মানুষ অন্যান্য পশুর থেকে আলাদা। বিষয়টি হচ্ছে মানুষের আকাঙ্ক্ষা যা সীমাহীন, এবং কখনও সম্পূর্ণরূপে পূরণ হয় না। এই আকাঙ্ক্ষা মানুষকে অস্থির করে রাখে সারা জীবন।
মানুষের
বহু রকমের আকাঙ্ক্ষা থাকে। তবে
সব আকাঙ্ক্ষার রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই। ইংরেজ
চিন্তাবিদ, দার্শনিক এবং প্রবন্ধকার বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর নোবেল বক্তৃতায় (১৯৫০)
চার রকমের আকাঙ্খার কথা বলেছেন যেগুলি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলি হচ্ছে — অর্জনলিপ্সা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অহমিকা, ও ক্ষমতাপ্রীতি।
অর্জনলিপ্সা
হচ্ছে যত বেশি সম্ভব সম্পদের মালিক হওয়ার ইচ্ছা। জীবনধারণের পক্ষে অপরিহার্য জিনিসপত্র সংগ্রহ দিয়ে এর শুরু হয়। একটা অর্জিত হলে আর একটা চাই। যত
বেশি সম্পদই অর্জন করা হোক না কেন, মানুষ সব সময়
চায় আরও অর্জন করতে। তৃপ্তি
চিরকাল স্বপ্ন হয়ে মানুষকে ফাঁকি দেয়।
তবে
অর্জনলিপ্সা ততটা দোষের নয়, যতটা দোষের প্রতিদ্বন্দ্বিতার
আকাঙ্ক্ষা। বস্তুত,
পৃথিবীটা এখনকার চেয়ে অনেক সুখের হতো যদি সব সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে
অর্জনলিপ্সা শক্তিশালী হতো।
কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, বহু মানুষ আছেন
যাঁরা সানন্দে নিজের ক্ষতি মেনে নেন যদি তাতে প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। তাঁরা নিজের নাক
কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে দ্বিধাবোধ করেন না।
অতীতে
এক সম্রাটের একাধিক স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে ধ্বংস হয়েছে
সাম্রাজ্য। ধর্মে-ধর্মে
প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে হয়েছে ধর্মযুদ্ধ।
রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে হয়েছে বিশ্বযুদ্ধ। ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে ভেঙেছে হৃদয়।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা আসে আত্মগরিমা বা অহমিকা থেকে। আত্মগরিমা এমন একটি তাড়না যার রয়েছে অপরিমেয় শক্তি। যারা শিশুদের সংস্রবে এসেছেন তারা জানেন, শিশুরা বারেবারে কেমন বোকার মতো আচরণ করে জানান দেয় — ‘আমার দিকে তাকাও’। ‘আমার দিকে তাকাও’ হচ্ছে মানব হৃদয়ের অন্যতম প্রাথমিক আকাঙ্ক্ষা। শৈশব থেকে আমরা নানাভাবে নিজের দিকে অপরের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি। এই আকাঙ্খা চরিতার্থের রূপ হতে পারে বহুবিধ — ভাঁড়ামি থেকে শুরু করে মরণোত্তর খ্যাতি অর্জনের চেষ্টা পর্যন্ত। এই অহমিকার কারণে আমরা অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হই, যুদ্ধ করি।
চারটি
আকাঙ্খার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে ক্ষমতাপ্রীতি। ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা এবং আত্মগরিমার আকাঙ্ক্ষা (অহমিকা) সগোত্রীয় হলেও, এক নয়। আত্মগরিমা
তৃপ্তির জন্য চাই যশ, গৌরব, প্রশংসা, স্তুতি। ক্ষমতা ছাড়াও এসব সহজেই অর্জন করা যেতে পারে। যেমনটা হয় একজন অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী, কিংবা ক্রীড়াবিদের বেলায়। অনেক মানুষ আছেন যাঁরা ক্ষমতার চেয়ে গৌরব বেশি
পছন্দ করেন। তাঁরা ঘটনা প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন না। যাঁরা গৌরবের
চেয়ে ক্ষমতা বেশি পছন্দ করেন তাঁরাই মোটের উপর, ঘটনার
গতিপথ প্রভাবিত করে থাকেন।
ক্ষমতাপ্রীতি,
অহমিকার মতো, কিছুতেই তৃপ্ত হয় না। যেন অসীম ও সর্বাত্মক ক্ষমতাসম্পন্ন না হতে পারলে তা তৃপ্ত হওয়ার নয়। এটা শক্তিশালী ও
গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের প্রধান আকাঙ্ক্ষা।