ডারউইন ও ময়ূরপুচ্ছ
জীবজগতে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন প্রাণী বোধ হয় ময়ূর। ময়ূর যখন তার বিচিত্রবর্ণের পাখা মেলে ধরে তখন রুদ্ধশ্বাস বিস্ময়ে না তাকিয়ে পারা যায় না। ময়ূরের সৌন্দর্যের মূল রহস্য তার জমকালো বহুবর্ণা লেজ বা পুচ্ছ। তবে ময়ূরপুচ্ছ সুন্দর হলেও তার দেহের তুলনায় অত্যন্ত ভারী। সম্ভবত গুরুভার লেজের কারণেই ময়ূর পাখি হলেও উড়তে পারে না। লঘুভার টুনটুনি পাখি ময়ূর সম্পর্কে কী বলে তা দেখে নেওয়া যাক রবীন্দ্রনাথের এই কবিতায় —
টুনটুনি কহিলেন, ‘রে ময়ূর, তোকেদেখে করুণায় মোর জল আসে চোখে।’ময়ূর কহিল, ‘বটে! কেন, কহ শুনি,ওগো মহাশয় পক্ষী, ওগো টুনটুনি।’টুনটুনি কহে, ‘এ যে দেখিতে বেআড়া,দেহ তব যত বড়ো পুচ্ছ তারো বাড়া।আমি দেখো লঘুভারে ফিরি দিনরাত,তোমার পশ্চাতে পুচ্ছ বিষম উৎপাত।’ময়ূর কহিল, ‘শোক করিয়ো না মিছে —জেনো ভাই, ভার থাকে গৌরবের পিছে।’(ভার<কণিকা)
টুনটুনি পাখির মতে, গুরুভার পুচ্ছ ময়ূরের জন্য বিষম উৎপাত বিশেষ। শুধু টুনটুনি পাখি নয়, ময়ূরের পুচ্ছ ভীষণ অপছন্দ করতেন বিবর্তন তত্ত্বের প্রবক্তা চার্লস ডারউইন। তিনি ময়ূরপুচ্ছ এতটাই অপছন্দ করতেন যে, এক বন্ধুকে লেখা চিঠিতে বলেছেন, ‘যখনই ময়ূরপুচ্ছের পালকের দিকে তাকাই, আমার বমি-বমি ভাব হয়।’ কেন তিনি এমন কথা বলেছেন? ময়ূরপুচ্ছের অভিজাত সৌন্দর্য দেখে তাঁর মতো একজন প্রকৃতিবাদী মানুষের তো বিস্ময়াভিভূত হওয়ার কথা!
সৌন্দর্যের
বিষয়ে তাঁর ভীতির কথা ডারউইন সামান্য উল্লেখ করেছেন তার বিখ্যাত বই ‘দ্য অরিজিন অফ
স্পিসিজ’-এ।
তিনি বলেছেন, ‘some naturalists believe that many structures have been created
for the sake of beauty ... Such doctrines, if true, would
be absolutely fatal to my theory.’ (Chapter VI). অর্থাৎ ‘কিছু প্রকৃতিবাদী বিশ্বাস করেন, জীবদেহে অনেক কাঠামো তৈরি হয়েছে
শুধু সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য। এই মতবাদ সত্য হলে, তা হবে আমার তত্ত্বের জন্য চরম
ধ্বংসাত্মক।’ অন্য
কথায়, ডারউইন যখন ময়ূরপুচ্ছের মধ্যে অনন্য সুন্দর কারুশিল্পের নিদর্শন লক্ষ করলেন,
তিনি মনে করলেন এটা তাঁর বিবর্তন তত্ত্বের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। কারণ ময়ূরপুচ্ছের সৌন্দর্য ময়ূরের
টিকে থাকার লড়াইয়ে কী সুবিধা দিয়েছে তা তাঁর কাছে স্পষ্ট ছিল না।
প্রকৃতপক্ষে, ডারউইনের
তত্ত্ব সম্পূর্ণ উপযোগিতাবাদী। এই তত্ত্ব অনুসারে, প্রজাতির টিকে
থাকার লড়াইয়ে সাহায্য করে শুধু এমন বৈশিষ্ট্যই পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। অর্থাৎ
প্রতিটি জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের উপযোগিতা থাকে। উপযোগিতা ছাড়া কোনও বৈশিষ্টের
অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
এটা স্পষ্ট যে,
ময়ূরের পুচ্ছ উড়ার জন্য তৈরি হয়নি। তাহলে ময়ূরপুচ্ছের উপযোগিতা কী? সুন্দর
পুচ্ছ ময়ূরকে অভাবনীয় সুন্দর করেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সৌন্দর্যের উপযোগিতা কী? ময়ূরের
বিবর্তনে কী অবদান রেখেছিল তার সৌন্দর্য? এই প্রশ্ন ছিল ডারউইনের জন্য এক বিরাট ধাঁধা। তাঁর
চিন্তায় সৌন্দর্য ছিল এমন এক ভীতিজনক সমস্যা যা তিনি অতিক্রম করতে পারছিলেন না। কেন,
সেটা বোঝার জন্য আমরা ত্বরিত ডারউইনের তত্ত্ব সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক তথ্যাদি জেনে
নিব।
ডারউইনের তত্ত্ব
অনুসারে প্রাণীর বিবর্তনের জন্য প্রয়োজন দুটি উপাদান — ১) টিকে থাকার লড়াই
(অর্থাৎ, সীমিত খাদ্য, ইত্যাদি), এবং ২) মিউটেশন বা জিনঘটিত পরিবর্তন যা কোনও
প্রজাতির একটি প্রাণীকে অন্যদের থেকে সুবিধা প্রদান করে।
সহজ কোথায়, ধরুন
একটি পাখি জন্ম নিল এমন মিউটেশন নিয়ে যা তাকে দিল সামান্য লম্বা ঠোঁট। লম্বা
ঠোঁটের কারণে সে সবচেয়ে বেশি খাদ্য আহরণ করতে থাকল। আর ছোট
ঠোঁটের পাখিরা যথেষ্ট খাবার না পেয়ে, একে একে মরে গেল। তখন
লম্বা ঠোঁটওয়ালা পাখি থেকে যে বাচ্চাকাচ্চা জন্ম নিল তাদের মধ্যে লম্বা ঠোঁটের
বৈশিষ্ট্য সঞ্চারিত হতে থাকল। দীর্ঘকাল ধরে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে এক সময় দেখা
যাবে এই প্রজাতির সব পাখিরই ঠোঁট লম্বা। এখানে টিকে থাকার লড়াইয়ে লম্বা
ঠোঁটওয়ালা পাখির জয় হল। এটাই ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্যতমরাই শেষপর্যন্ত
টিকে থাকে’ তত্ত্বের সারাংশ।
এমনিতে ডারউইনের
তত্ত্ব যুক্তিনিষ্ঠ এবং প্রয়োগযোগ্য মনে হতে পারে। কিন্তু
সমস্যা দেখা দেয় সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে। কারণ, ডারউইনের তত্ত্বে সৌন্দর্যের
কোনও স্থান নেই।
আদিম প্রাণীর টিকে
থাকার লড়াইয়ে সৌন্দর্য কী সুবিধা দিয়েছে তা স্পষ্ট নয়। ময়ূরের
উজ্জ্বল রঙিন পুচ্ছ তার জীবনধারণের জন্য সুবিধাজনক তো নয়ই, বরং উৎপাত বিশেষ। ময়ূরপুচ্ছের
উজ্জ্বল পালক যেন নিয়ন-আলোয় আলোকিত বিজ্ঞাপন, শিকারি পশুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে
বলছে — ‘এখানে আমি! এসো আমাকে খাও!’
উজ্জ্বল রঙের পুচ্ছ
ময়ূরকে শিকারজীবী মাংসাশী প্রাণীর চোখে আরও বেশি দৃশ্যমান করেছে। এবং
ভারী পুচ্ছ ময়ূরের নিরাপদ পলায়ন ধীরগতি করেছে। এসব
কারণে ময়ূরের টিকে থাকার কথা নয়। কিন্তু ময়ূর টিকে আছে। তবে কি প্রাকৃতিক নির্বাচন এখানে কাজ
করেনি? ডারউইনের তত্ত্ব কি ভুল?
ময়ূরপুচ্ছ সংক্রান্ত
ধাঁধা নিরসন করতে ডারউইন অবশেষে ‘সেক্সচুয়াল সিলেকশন’ অর্থাৎ ‘যৌন নির্বাচন’
তত্ত্বের প্রস্তাব করেন। এই তত্ত্ব অনুসারে, সুন্দর পুচ্ছওয়ালা ময়ূরকে দেখে ময়ূরী খুব মুগ্ধ হয়
এবং তাকে মিলনের সঙ্গী হিসাবে নির্বাচন করে। যেহেতু ময়ূরী পছন্দ করে তাই ময়ূরপুচ্ছ
বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে, প্রজাতির সব পুরুষ ময়ূরই হয়
বর্ণাঢ্য পুচ্ছওয়ালা। এখানে প্রকৃতি নয়, ময়ূরী নির্বাচন করে তার পছন্দের বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু সমস্যা
হচ্ছে, যে-বৈশিষ্ট্য ময়ূরকে ময়ূরীর কাছে আকর্ষণীয় করেছে, সেই একই বৈশিষ্ট্য ময়ূরকে
শিকারজীবী প্রাণীর কাছেও আকর্ষণীয় করেছে। ফলে ময়ূর হয়েছে অধিক আক্রান্তপ্রবণ। ময়ূরীকে
কেন রঙিন পালকের প্রতি আকৃষ্ট হতে হবে তার কোনও যুক্তি নেই, বিশেষত যখন এর ফলে
ময়ূরের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এমন হলে ভাল হতো নয় কি যদি শিকারি
প্রাণীর নজর এড়াতে ময়ূরের লেজের রং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে মিশিয়ে লুকিয়ে
রাখা যেত?
ডারউইনের ‘যৌন
নির্বাচন’ তত্ত্ব অনুসারে, প্রজননের উদ্দেশে ময়ূরীর যৌনসঙ্গী নির্বাচনের
প্রতিক্রিয়ায় ময়ূরের পুচ্ছের উদ্ভব হয়েছে। অন্য কথায়, ময়ূরের পুচ্ছ তৈরি হয়েছে
ময়ূরীকে মুগ্ধ করার জন্য। এই মুগ্ধতা ময়ূর-ময়ুরীর মিলন নিশ্চিত করেছে। যা তাদের বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। আর এভাবেই পুচ্ছের সৌন্দর্য ময়ূরের
বিবর্তনে অবদান রেখেছে বলে ডারউইন মনে করতেন।
সম্প্রতি, তাও
প্রায় বিশ বছর আগে, ময়ূরীর সঙ্গী নির্বাচনে ময়ূরপুচ্ছের ভূমিকা কী তা অনুসন্ধান করার
উদ্দেশে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
মারিকো তাকাহাশি। মারিকো’র
দল বুনো ময়ূর-ময়ূরী নিয়ে সাত বছর ব্যাপী গবেষণার সময় ২৬৮টি সফল যৌনমিলন প্রত্যক্ষ
করেন।
কিন্তু বিস্ময়করভাবে তাঁরা দেখতে পান যে, ময়ূরী যতবার সুন্দর ময়ূরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে,
প্রায় ততবারই অসুন্দর ময়ূরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। অধিক
সুন্দর পুচ্ছবিশিষ্টি ময়ূরের প্রতি ময়ূরীর অধিকতর আকর্ষণের কোনও প্রমাণ তাঁরা পাননি। ময়ূরপুচ্ছে
চোখের সংখ্যা, পালকের বিন্যাস, অথবা পুচ্ছের দৈর্ঘ্য — এসবের প্রতি ময়ূরী ছিল নির্বিকার,
প্রতিক্রিয়াহীন। মারিকো
সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ময়ূরের পুচ্ছ ময়ূরীর যৌন নির্বাচনে কোনও অবদান রাখে না। তাঁর
এই সিদ্ধান্ত ডারউইনের ‘যৌন নির্বাচন’ তত্ত্বের বিরোধী।
২০০৮ সালে মারিকো
তাকাহাশির গবেষণাপত্র প্রকাশের পর যখন জানা হল ময়ূরীর কাছে ময়ূরপুচ্ছের যৌন আবেদন
নেই, তখন ময়ূরপুচ্ছের ভিন্ন উপযোগিতার কথা প্রস্তাব করা হল। বলা হল, ময়ূরের পুচ্ছ ময়ূরীকে আকর্ষণ
করতে নয়, বরং শিকারজীবী প্রাণীদের ভয় দেখিয়ে দূরে রাখতে ব্যবহৃত হয়। হতে
পারে, একজনের কাছে যা সুন্দর, অন্যজনের কাছে তা ভয়ংকর! ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ বলেও তো একটা
কথা আছে।
‘যৌন নির্বাচন’
ছিল ডারউইনের একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। একই
প্রজাতির স্ত্রী ও পুরুষ প্রাণীর মধ্যকার স্বাভাবিক নান্দনিক ভিন্নতা এই তত্ত্বের প্রধান
উপজীব্য। সহজ
কথায়, প্রাকৃতিক নির্বাচন ছিল ‘টিকে থাকার লড়াই’ আর ‘যৌন নির্বাচন’ — ‘সঙ্গী জোগাড়ের
লড়াই’।
সঙ্গী নির্বাচনে স্ত্রী-প্রাণীর নন্দনতাত্ত্বিক দক্ষতার কারণেই পুরুষ প্রাণীর
মধ্যে সৌন্দর্যবর্ধক বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হয়েছে। যেমন,
পুচ্ছের সৌন্দর্যে ময়ূরী মুগ্ধ হয়েছে বলেই ময়ূরের দেহে পুচ্ছের উদ্ভব ঘটেছে।
কিন্তু প্রশ্ন
থেকে যায়, স্ত্রী-প্রাণীরা কি নন্দনতাত্ত্বিকভাবে দক্ষ? অর্থাৎ, তারা কি
সৌন্দর্যের রসগ্রহণে সক্ষম? মনুষ্যজাতির বাইরে অন্য প্রাণীদের মধ্যে কি সৌন্দর্যবোধ
সৃষ্টি হয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে ডারউইনের ‘যৌন নির্বাচন’ তত্ত্ব কতটা
সুযুক্তিপূর্ণ?
আর এই যে
প্রকৃতি-জগৎ ক্রমাগত সৌন্দর্য রচনা করে চলেছে সে কি দৈবক্রমে, না কি ইচ্ছাপূর্বক —
সে প্রশ্নও এড়ানো যায় না।