ময়ূরের সৌন্দর্য ও বিবর্তনের রহস্য
জীবজগতে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন প্রাণীদের মধ্যে ময়ূর অন্যতম। ময়ূর যখন
তার বিচিত্রবর্ণের পাখা মেলে ধরে, তখন তা এক অপার বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। ময়ূরের সৌন্দর্যের মূল রহস্য তার
জমকালো বহুবর্ণা লেজ বা পুচ্ছ। তবে এই পুচ্ছ তার দেহের তুলনায় অত্যন্ত ভারী,
যা সম্ভবত তাকে উড়তে বাধা দেয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় টুনটুনি পাখি ময়ূরের ভারী লেজ নিয়ে ব্যঙ্গ করে বলেছিল: ‘রে ময়ূর, তোকে দেখে করুণায় মোর জল আসে চোখে। … আমি দেখো লঘুভারে ফিরি দিনরাত, তোমার পশ্চাতে পুচ্ছ বিষম উৎপাত।’ তবে ময়ূর পাল্টা যুক্তি দেয় যে, ভার থাকলেই তা উৎপাত হয় না, বরং গৌরবের প্রতীকও হতে পারে।
ডারউইনের দৃষ্টিভঙ্গি ও যৌন নির্বাচন তত্ত্ব
বিবর্তন তত্ত্বের প্রবক্তা চার্লস ডারউইন ময়ূরের পুচ্ছ সম্পর্কে
ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। তিনি ময়ূরপুচ্ছ এতটাই অপছন্দ করতেন যে, এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘যখনই
ময়ূরপুচ্ছের পালকের দিকে তাকাই, আমার বমি-বমি ভাব হয়।’
তার বিবর্তন তত্ত্ব অনুসারে, প্রাণীর প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের উপযোগিতা থাকা উচিত। কিন্তু ময়ূরের পুচ্ছ
দেখে তিনি বিভ্রান্ত হন, কারণ এটি কোনওভাবেই টিকে থাকার
লড়াইয়ে সুবিধা দেয় না, বরং শিকারীদের কাছে তাকে আরও দৃশ্যমান
করে তোলে।
এই ধাঁধার সমাধানে ডারউইন ‘যৌন
নির্বাচন’ তত্ত্বের প্রস্তাব করেন। তার মতে, ময়ূরীর পছন্দের কারণে ময়ূরের পুচ্ছ বিবর্তিত হয়েছে। ময়ূরী যেহেতু সুন্দর
লেজওয়ালা ময়ূরকে সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করে, তাই এই
বৈশিষ্ট্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়েছে।
আধুনিক গবেষণায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
তবে ২০০৮ সালে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যাপক মারিকো তাকাহাশির গবেষণায় দেখা যায়, ময়ূরীরা আসলে ময়ূরের পুচ্ছের প্রতি নিরপেক্ষ। তাদের সঙ্গী নির্বাচনে
পুচ্ছের সৌন্দর্য কোনও ভূমিকা রাখে না। এই গবেষণা যৌন নির্বাচনের তত্ত্বকে
প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিকল্প ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়, ময়ূরের
পুচ্ছ শিকারীদের ভয় দেখানোর জন্য বিবর্তিত হতে পারে।
সৌন্দর্যের রহস্য ও বিবর্তন
ডারউইনের ‘যৌন নির্বাচন’ তত্ত্বের
আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ দিক হল, স্ত্রী-প্রাণীরা কি
সত্যিই নন্দনতাত্ত্বিকভাবে সক্ষম? প্রকৃতি ক্রমাগত সৌন্দর্য
সৃষ্টি করছে, কিন্তু তা কি কেবল দৈবক্রমে, নাকি এর পেছনে কোনও গভীর প্রক্রিয়া কাজ করছে? বিজ্ঞানীরা
মনে করেন, প্রকৃতির বৈচিত্র্য এবং সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করার
জন্য আরও ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। এতে বিভিন্ন প্রাণীর আচরণগত বৈচিত্র্য,
পরিবেশগত অভিযোজন, এবং সামাজিক
পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় রাখা উচিত।
ময়ূরের পুচ্ছ শুধুই শোভাবর্ধনকারী না কি বিবর্তনের একটি জটিল রহস্য, তা আজও গবেষণার বিষয়। সৌন্দর্য এবং প্রাকৃতিক
নির্বাচনের এই দ্বন্দ্ব বিজ্ঞানীদের জন্য এক চিরন্তন ধাঁধা হয়ে রয়ে গেছে।