অকারণ সুখ : অন্তরের পরিপূর্ণতা
সুখ — মনের এমন এক অবস্থা, যা সবাই কামনা করে। সুস্থতা, স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ, ভালবাসা ও তৃপ্তির মতো ইতিবাচক অনুভূতিগুলোর সঙ্গে এটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষ নানাভাবে সুখ অনুভব করতে পারে — লক্ষ্য অর্জন, ইচ্ছাপূরণ, সুসংবাদ পাওয়া কিংবা প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানো ইত্যাদি তার কিছু সাধারণ মাধ্যম। তবে, কিছু সময় কোনও বাহ্যিক কারণ ছাড়াই মানুষ সুখের অভিজ্ঞতা লাভ করে, যা অকারণ-সুখ নামে পরিচিত।
সাধারণভাবে, মানুষ মনে করে — 'আমি সুখী হব, যদি যা চাই তা পাই এবং
যা চাই না তা এড়িয়ে চলতে পারি।’ এ ধরনের সুখ নির্ভরশীল ও শর্তযুক্ত, যা আসলে এক মরীচিকা। কারণ, আকাঙ্ক্ষার কোনও শেষ
নেই; একটির পর আরেকটি চাওয়া সামনে এসে দাঁড়ায়, ফলে সুখ অধরা থেকে যায়।
পক্ষান্তরে, অকারণ-সুখ নিঃশর্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত, যা মানুষের অন্তর্নিহিত স্বাভাবিক অবস্থা।
আমাদের দৈনন্দিন
সামাজিক বিনিময়ে আমরা জিজ্ঞেস করি — ‘কেমন আছেন?’ যদি কেউ উত্তর দেয়, ‘ভাল আছি’, সাধারণত আমরা আর জানতে
চাই না — কেন ভাল আছেন? সুখ ও সুস্থতা আমাদের
স্বাভাবিক অবস্থা বলেই এ প্রশ্ন অবান্তর মনে হয়। কিন্তু কেউ যদি বলে, ‘ভাল নেই’, তখন তার অসুস্থতা বা অসুখের কারণ খোঁজা স্বাভাবিক সৌজন্য হিসেবেই ধরা হয়। এর
থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, ভাল থাকার কোনও কারণ
লাগে না, কিন্তু খারাপ থাকার অনেক কারণ
থাকতে পারে।
আমাদের শরীর নামক
‘হার্ডওয়্যার’-এর ‘অপারেটিং সিস্টেম’-এ ইতিবাচক বিষয়গুলো, যেমন — ভাল থাকা, সুস্থ থাকা, সুখী থাকা — এগুলো পূর্বনির্ধারিত নির্দেশনা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। জীবনের
মনিটরে সুখ স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভাসিত হয়, যদি না কোনও মানসিক বা
বাহ্যিক ব্যাঘাত ঘটে। অর্থাৎ, ভাল থাকাটাই স্বাভাবিক, সুখী থাকাটাই স্বাভাবিক।
অকারণ-সুখের শক্তি
অকারণ-সুখ বাহ্যিক
উপাদানের উপর নির্ভরশীল নয়। আমাদের কাছে কী আছে বা আমরা কী অর্জন করেছি, তা এখানে গৌণ। আসল বিষয় হল — আমরা কেমন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করি। যদি প্রতিদিন
আমাদের জীবনের ইতিবাচক দিকগুলোর প্রতি সচেতন মনোযোগ দিই, তাহলে নেতিবাচক চিন্তাগুলো আমাদের কলুষিত করতে পারবে না। কৃতজ্ঞতাবোধ ও
প্রশংসা জন্ম নেবে, যা আমাদের মনকে
পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলবে।
অকারণ-সুখ শুধু আমাদের
ব্যক্তিগত জীবনে নয়, আমাদের চারপাশেও
ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। যখন আমরা সুখী থাকি, তখন সেই সুখ আমাদের
আচরণে প্রতিফলিত হয় — যা অন্যদের মনেও আনন্দ ছড়িয়ে দেয়, ঠিক ফুলের সুবাসের মতো। সুখী হৃদয়ের প্রশান্তি ইতিবাচক মানুষ ও অভিজ্ঞতাকে
আমাদের জীবনে আকৃষ্ট করে, যা আমাদের আরও সমৃদ্ধ
করে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ
দিক হল, অকারণ-সুখ আমাদের প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় অধিক সক্ষম করে তোলে। আনন্দ ও শান্তিময় মন জীবনসংকট, চাপ ও ধকল সামলাতে বেশি
দক্ষ হয়। সুখ যদি বাহ্যিক বস্তু বা পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে তা সাময়িক; কিন্তু যদি তা
অভ্যন্তরীণ চেতনার ফল হয়, তবে তা স্থায়ী ও অটল
থাকে।
সুখের জন্য শর্ত নয়, সিদ্ধান্ত প্রয়োজন
সুখ আসলে এক অভ্যন্তরীণ
পরিপূর্ণতার অনুভূতি — বাহ্যিক আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি নয়। তাই সুখের জন্য কোনও শর্ত
আরোপের প্রয়োজন নেই। উপনিষদেও বলা হয়েছে — ‘যে সুখ শর্তসাপেক্ষ, তা দুঃখের আরেক রূপ।’ প্রকৃত সুখ নিঃশর্ত ও নিরপেক্ষ।
অকারণ সুখ লাভের জন্য
আমাদের বিশেষ কিছু করতে হয় না। প্রয়োজন কেবল একটিই — মনস্থির করা। আন্তরিকভাবে সিদ্ধান্ত
নিতে হয় — ‘আজ
আমি সুখী হব।’
তাহলেই মনের গভীরে জেগে উঠবে সেই অনির্বচনীয় সুখের অনুভূতি।
উপসংহার
সুখ আসলে বাহ্যিক কোনও কিছু
নয়, এটি অন্তরের সম্পদ। মানুষের অন্তরের গভীরে সর্বদা বিরাজমান এক স্বতঃস্ফূর্ত সুখ-সায়র, যা আমাদের অপেক্ষায়
থাকে। প্রয়োজন কেবল সেই উপলব্ধির প্রতি আমাদের দৃষ্টি ফেরানো। যখন আমরা সচেতনভাবে
সুখের দিকে মনোনিবেশ করি, তখন তা ধীরে ধীরে
আমাদের জীবনকে পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ করে তোলে।