স্বপ্ন, বাস্তবতা ও অবচেতন মন

মানুষের মন প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত — সচেতন মন এবং অবচেতন মন। সচেতন মন আমাদের জাগ্রত অবস্থায় পরিচালিত করে, যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব নেয়। অন্যদিকে, অবচেতন মন কাজ করে অন্তরালে, আমাদের অনুভূতি, স্মৃতি ও স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণ করে। ঘুমের সময় যখন সচেতন মন নিষ্ক্রিয় হয়, তখন অবচেতন মন সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আমাদের মানসিক প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের মানসিক শক্তির মাত্র ৫-১০ শতাংশ সচেতন মনের অধীন, আর বাকি ৯০-৯৫ শতাংশ অবচেতন মন দ্বারা পরিচালিত

স্নায়ুবিজ্ঞানীরা মনে করেন, আমাদের মস্তিষ্কই বাস্তবতা গঠন করে। যেহেতু মনের প্রকৃতি দ্বিবিধ, তাই বাস্তবতাও দুই রকম — সচেতন মনের বাস্তবতা এবং অবচেতন মনের বাস্তবতা। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা যে জগৎ প্রত্যক্ষ করি, সেটাই সচেতন মনের বাস্তবতা। একে আমরা প্রকৃত বাস্তবতা বলে ধরে নিই। কিন্তু ঘুমের মধ্যে অবচেতন মন যে অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে, তাকেও এক ধরনের বাস্তবতা বলা যায়, যা স্বপ্নবাস্তবতা নামে পরিচিত। শিল্প, সাহিত্য ও মনস্তত্ত্বে একে পরাবাস্তব (surreal) বলা হয়, কারণ এটি যুক্তির সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে গিয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রকাশ করে

পরাবাস্তবতায় আমাদের অবচেতন মন এমন সব দৃশ্য ও অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে, যা সচেতন মনের জন্য রহস্যময় ও অদ্ভুত মনে হয়। স্বপ্ন দেখা অবচেতন মনের একটি স্বাভাবিক কাজ এবং এটি আমাদের অবচেতন মনকে বোঝার অন্যতম পথ। প্রতিদিন আমরা এক থেকে ছয়টি স্বপ্ন দেখি, যার কিছু আমরা মনে রাখি, কিছু হারিয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, স্বপ্নে সাধারণত আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, স্থান ও ঘটনা প্রতিফলিত হয়। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত — স্বপ্নে আমরা সম্পূর্ণ নতুন মুখ দেখতে পাই না। কারণ আমাদের মস্তিষ্ক ঘুমন্ত অবস্থায় বাইরের জগতের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখে এবং স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে পূর্বপরিচিত মুখ ও চিত্র তুলে আনে

স্বপ্ন কখনও এতটাই বাস্তবসম্মত মনে হয় যে ঘুম ভাঙার পরও বিভ্রম সৃষ্টি করে। এতে প্রশ্ন ওঠে — আমরা কীভাবে নিশ্চিত হব যে, জাগ্রত বাস্তবতা সত্য এবং স্বপ্ন কেবল এক বিভ্রম? হতে পারে, দুটোই সত্য, কিংবা দুটোই কল্পনার অংশ

প্রজাপতিস্বপ্ন দেখা

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, চীনা দার্শনিক জোয়াং জৌ (Zhuang Zhou) এই প্রশ্নটি তুলেছিলেন। তিনি এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন যে তিনি একটি প্রজাপতি হয়ে গেছেন এবং আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর তিনি বিস্মিত হলেন — তিনি কি জোয়াং জৌ, যে স্বপ্নে প্রজাপতি হয়েছিল? নাকি তিনি প্রজাপতি, যে এখন স্বপ্ন দেখছে যে সে একজন মানুষ?

জোয়াং জৌ-এর এই অভিজ্ঞতা একটি দার্শনিক কূটাভাস সৃষ্টি করে। যদি স্বপ্নে মানুষ প্রজাপতি হতে পারে, তবে প্রজাপতিও স্বপ্নে মানুষ হতে পারে। হতে পারে, স্বপ্নের ‘আমি’ ও জাগ্রত ‘আমি’ একই সত্তার ভিন্ন প্রকাশ। এমনও হতে পারে, আমাদের জাগ্রত অবস্থার বাস্তবতাও আরেকটি স্তরের স্বপ্ন মাত্র

জোয়াং জৌ-এর ‘প্রজাপতির স্বপ্ন’ শুধুমাত্র একটি দার্শনিক গল্প নয়; এটি বাস্তবতার প্রকৃতি সম্পর্কে গভীর প্রশ্ন তোলে। এটি আমাদের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানায়, চিন্তার দিগন্ত প্রসারিত করে এবং আমাদের স্বপ্ন ও বাস্তবতার রহস্যময়তা উপলব্ধি করতে উদ্বুদ্ধ করে 

Popular posts from this blog

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চেনার উপায়

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা — চন্দ্রসূর্যের মিলন ও বিরহ তিথি

তেলের সামাজিক মাহাত্ম্য

ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ

রাসলীলা মাহাত্ম্য

আঁধারের রূপ ও বিপন্নতা

আধ্যাত্মিকতা — পাশ্চাত্য ভাবধারার আলোকে

হৃদয়-দর্পনে দেখা

সূর্য উপাসনা