দুই পাখি: মানবজীবনের দ্বৈত রূপ
মানুষ চিরকাল পাখি দেখে মুগ্ধ হয়েছে।
পাখিরা শূন্যে আকাশের উঁচুতে উড়ে বেড়ায়, যেখানে নীচের পঙ্কিলতা তাদের স্পর্শ করতে পারে না। আকাশে পাখিদের এই অবাধ
বিচরণ দেখে মানুষ আধ্যাত্মিক জগতের ধারণা পেয়েছে। মনে হয়েছে, পাখি যেন কোনও আধ্যাত্মিক সত্তার দূত বা প্রতিনিধি।
বাংলার সংস্কৃতিতে এক বিমূর্ত পাখির
কল্পনা রয়েছে, যাকে লালন সাঁই বলেছেন ‘অচিন
পাখি’। এই অচিন পাখি পরিচয়হীন। মানুষের দেহসংশ্লিষ্ট পরিচয় — ধর্ম, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ, কুল, নাম ইত্যাদির সঙ্গে এর কোনও যোগ নেই। তাই একে
চেনার কোনও উপায় নেই। এই পাখি মানুষের চৈতন্য বা আত্মার প্রতীক।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনায় ‘দুই পাখি’র
কথা বলেছেন — খাঁচার পাখি এবং বনের পাখি। খাঁচার পাখি দেহধারী; তার বাস দেহরূপ খাঁচায়। আর বনের পাখি বাস করে অসীম
আকাশে। খাঁচার পাখি সংসারের শৃঙ্খলে বাঁধা, আর বনের পাখি
সংসারের বন্ধনমুক্ত।
উপনিষদেও দুই পাখির উল্লেখ আছে — ‘দুটি
পাখি পরস্পর যুক্ত ও সখ্যভাবাপন্ন হয়ে এক বৃক্ষ আশ্রয় করে আছে। তাদের মধ্যে একটি
স্বাদু ফল ভক্ষণ করে, আর অন্যটি ভোজন না
করে শুধু দেখে।’ এখানে জীবাত্মা ও পরমাত্মার তুলনা করা হয়েছে। জীবাত্মা ভোগে মত্ত,
কখনও সুখী, কখনও অসুখী। অন্যদিকে, পরমাত্মা ভোগে অংশ নেয় না, কেবল নির্লিপ্তভাবে
দেখে। এই দেখা তাকে সুখ-দুঃখের ঊর্ধ্বে স্থাপন করে, সদা
আনন্দময় করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘যে-পাখি দেখছে
তারই আনন্দ বড়ো আনন্দ। কেননা, তার সে বিশুদ্ধ আনন্দ,
মুক্ত আনন্দ’ (জাপান যাত্রী)।
![]() |
দুই পাখি |
প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ‘দুই পাখি’
আছে। প্রথম পাখি জীবনের রূপক — যে জীবনে আমরা লেখাপড়া শিখি, চাকরি করি, সংসার করি। এই পাখি
জীবন উপভোগ করে। দ্বিতীয় পাখি দেখতে প্রথম পাখির মতো হলেও তার কাজ কেবল দেখা। সে
নীরবে প্রথম পাখির কার্যকলাপ নির্লিপ্তভাবে পর্যবেক্ষণ করে।
দ্বিতীয় পাখি আমাদের এক বিশেষ
ক্ষমতার প্রতীক। এই ক্ষমতার মাধ্যমে আমরা নিজেদের অনুভূতি ও চিন্তাধারা দেখতে
পারি। এই দেখা ভালো-মন্দ বিচারহীন, অথচ সজাগ। একে বলা হয় ‘পাখির মতো দেখা’। পাখি যেমন নির্লিপ্তভাবে দেখে,
তেমনি আমাদেরও এই দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে।
রবীন্দ্রনাথের গানে আছে — ‘চোখের
আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে। অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে।’ এখানে তিনি চোখের দুই রকমের দৃষ্টির কথা বলেছেন — চোখ
বাইরেও দেখে, অন্তরেও দেখে। বাইরের দৃষ্টি প্রথম পাখির,
আর অন্তরের দৃষ্টি দ্বিতীয় পাখির।
অন্তরে দেখা মানে নিজের মনের অনুভূতি
ও চিন্তাকে দেখা। তবে এই দেখা আবেগহীন, নন-জাজমেন্টাল। মেডিটেশনের সময় এই ধরনের নির্লিপ্ত দৃষ্টি ব্যবহৃত হয়,
যেখানে চিন্তাধারা, নিশ্বাস-প্রশ্বাস ও
ইন্দ্রিয়ানুভব পর্যবেক্ষণ করা হয়।
দুই পাখির রূপক মানব প্রকৃতির দ্বৈততার প্রতীক। এই দুই পাখি — জীবাত্মা ও পরমাত্মা, শরীর ও আত্মা, বহির্দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টি। তাদের সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে, কী ছিল বিধাতার মনে।’ ▣