ওপেনহাইমার: এক বিস্ময়কর প্রতিভার দ্বন্দ্ব

রবার্ট ওপেনহাইমার ছিলেন এক অসামান্য প্রতিভাধর বিজ্ঞানী। তাঁর অবদান কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, তিনি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন পরমাণু বোমা তৈরির নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি আমেরিকার ম্যানহাটন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বেই তৈরি পরমাণু বোমা ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত হয়

জ্ঞানসাধনা ও বহুমুখী কৌতূহল

ওপেনহাইমার ছিলেন বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী। বিজ্ঞানের পাশাপাশি দর্শন, সাহিত্য ও আধ্যাত্মিকতায়ও ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। কার্ল মার্কস, সিগমন্ড ফ্রয়েড, ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা — এসব বিষয়েও তাঁর গভীর অধ্যয়ন ছিল। তিনি সংস্কৃত ভাষা শিখে মূল ভাষায় ভগবদগীতা পড়েছিলেন। তাঁর জীবনদর্শনের গঠনে ভগবদগীতা ও শার্ল বোদলেয়ারের ‘দ্য ফ্লাওয়ারস অফ ইভিল’ বই দুটি বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল

বিজ্ঞানী, কবি ও দার্শনিক

ওপেনহাইমার সম্পর্কে বলা হয়, তিনি ছিলেন একজন ‘scientist who writes like a poet, and speaks like a prophet’সূক্ষ্ম সৌন্দর্যের প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ। তিনি বোদলেয়ারের কবিতা ফরাসি ভাষায় এবং ভগবদগীতা সংস্কৃতে পড়েছিলেন। এমন একজন সংবেদনশীল মানুষ কীভাবে ধ্বংসাত্মক অস্ত্র নির্মাণে নেতৃত্ব দিলেন, তা বিস্ময়ের বিষয়। কিন্তু তাঁর দৃষ্টিতে বিজ্ঞানীর কাজ হল নতুন আবিষ্কার করা, এর প্রয়োগ নির্ধারণ করে রাজনীতিবিদরা

আমেরিকান প্রমিথিউস

ওপেনহাইমারকে বলা হয় ‘আমেরিকান প্রমিথিউস’। গ্রিক পুরাণে প্রমিথিউস দেবতাদের কাছ থেকে আগুন চুরি করে মনুষ্যজাতিকে উপহার দেন। ওপেনহাইমার মানবজাতির জন্য মুক্ত করেন পরমাণুর অভ্যন্তরে আবদ্ধ শক্তি। এই কারণেই তিনি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন


নৈতিক উভয়সংকট ও গীতার আশ্রয়

পরমাণু বোমার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ওপেনহাইমার এক গভীর নৈতিক সংকটে পড়েন। বিজ্ঞানী হিসেবে আবিষ্কারের আনন্দ, আর সেই আবিষ্কারের ধ্বংসাত্মক পরিণতি — এই দ্বন্দ্বে তিনি ক্লিষ্ট হয়ে পড়েন। গীতার শিক্ষা তাঁকে এই সংকট মোকাবিলায় সাহায্য করে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কৃষ্ণ যেমন অর্জুনকে কর্তব্যপালনের নির্দেশ দেন, তেমনি ওপেনহাইমারও অনুভব করেন যে, বিজ্ঞানীর কাজ গবেষণা করা, এর ব্যবহারের সিদ্ধান্ত অন্যদের উপর ন্যস্ত

কাল’ এবং ধ্বংসের পরিণতি

পরমাণু বোমার প্রথম পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ‘ট্রিনিটি’ কোডনামে ১৬ জুলাই ১৯৪৫ সালে নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে সম্পন্ন হয়। বিস্ফোরণের প্রাবল্য দেখে ওপেনহাইমারের মনে ভগবদগীতার শ্লোক উদিত হয় — ‘If the radiance of a thousand suns were to burst at once into the sky, that would be like the splendor of the mighty one।’ পরে, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা বিস্ফোরণের পর তিনি বলেন, ‘Now, I am become Death, the destroyer of worlds।’ যদিও অনেকে মনে করেন, এটি গীতার ভুল উদ্ধৃতি, তবে সংস্কৃত ‘কাল’ শব্দের অর্থ ‘সময়’ ও ‘মৃত্যু’ — দুইভাবেই নেওয়া যায়

অনুশোচনা ও পরিণতি

যুদ্ধের পর ওপেনহাইমার পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান। কিন্তু শীতল যুদ্ধের সময় তাঁকে ‘অনাস্থাভাজন’ ঘোষণা করে আমেরিকান প্রশাসন তাঁর ‘সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স’ বাতিল করে। যাদের হাতে তিনি পৃথিবী ধ্বংসের শক্তি তুলে দিয়েছিলেন, তারাই তাঁকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিল — এ যেন ভাগ্যের নির্মম পরিহাস

ওপেনহাইমার ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ

২২ এপ্রিল ওপেনহাইমারের জন্মদিন। একই দিনে পালিত হয় ‘পৃথিবী দিবস’। আজকের বিশ্বে প্লাস্টিক ও কার্বন ডাই-অক্সাইড দূষণ নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতা নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। অথচ পরমাণু বোমাই মানব সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। পৃথিবীকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করার বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলা। এটাই হতে পারে ওপেনহাইমারের প্রকৃত উত্তরাধিকার 

Popular posts from this blog

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চেনার উপায়

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা — চন্দ্রসূর্যের মিলন ও বিরহ তিথি

তেলের সামাজিক মাহাত্ম্য

ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ

রাসলীলা মাহাত্ম্য

আঁধারের রূপ ও বিপন্নতা

আধ্যাত্মিকতা — পাশ্চাত্য ভাবধারার আলোকে

সূর্য উপাসনা

হৃদয়-দর্পনে দেখা