সনাতন ধর্ম: চিরন্তন সত্য ও হিন্দুর জীবনদর্শন

সনাতন ধর্ম’ — এক গভীরতর ভাবধারার নাম, যা হিন্দুধর্মের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হলেও তার চেয়ে অনেক বিস্তৃত, অনেক ব্যাপক। হিন্দুরা তাঁদের ধর্মীয় ও দার্শনিক ঐতিহ্যকে ‘সনাতন ধর্ম’ বলেই চিহ্নিত করেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, ‘সনাতন’ শব্দটির তাৎপর্য কী? কেনই বা এই ধর্মকে ‘সনাতন’ বলা হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন

শব্দতত্ত্ব: ‘সনাতন’ ও ‘ধর্ম’ শব্দের অন্তর্নিহিত ব্যাকরণ

সনাতনশব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘সন’ ধাতু থেকে, যার অর্থ — চিরন্তন, অনাদি, অবিনাশী। অর্থাৎ, যা কালের সীমায় আবদ্ধ নয়, যা সর্বকালেই সত্য, তা-ই সনাতন

ধর্মশব্দের উৎস ‘ধৃ’ ধাতু — যার অর্থ ধারণ করা। যে তত্ত্ব ব্যক্তি, সমাজ ও বিশ্বকে ধরে রাখে, সংহত রাখে, শৃঙ্খলাবদ্ধ করে — তা-ই ধর্ম

এই অর্থে, ‘সনাতন ধর্ম’ হল সেই অনাদি নৈতিক শক্তি, যা ব্যক্তি ও সমাজকে চিরকাল ধরে ধারণ করে চলেছে

সনাতন ধর্মের দুই প্রাসঙ্গিক অর্থ

সনাতন ধর্ম মূলত দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়:

১)প্রচলিত ও প্রাচীন ধর্ম অর্থে: যদিও সনাতন ধর্মের উৎপত্তি অতি প্রাচীন, ‘সনাতন ধর্ম’ শব্দটি ব্যবহারিক গুরুত্ব পায় ইসলামি যুগের পর। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম শাসনের সূচনার পর ভারতের মূল সংস্কৃতিকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। হিন্দু সম্প্রদায় তখন তাঁদের ঐতিহ্যকে ‘সনাতন ধর্ম’ নামে অভিহিত করতে শুরু করেন — যেন স্পষ্ট করা যায়, এটি কোনও বাইরের ধর্ম নয়, বরং এই ভূমিরই নিজস্ব, শাশ্বত, অভ্যন্তরীণ ধারাবাহিকতা

তবে, এই শব্দবন্ধ শুধু প্রতিক্রিয়াত্মক নয় — এটি এক আত্মজাগরণ, যা আত্মপরিচয় ও অস্তিত্ব রক্ষার প্রতীক

২) অপরিবর্তনীয় ও চিরস্থায়ী ধর্ম অর্থে:সনাতন ধর্ম’ এমন এক ধর্ম বা নীতি, যা পরিবর্তনশীল নয়, চিরন্তন। তথাপি এই ধর্ম স্থবির নয়। কারণ এটি কোনও বিশেষ মতবাদে গন্ডিবদ্ধ নয় — বরং এক চলমান, গতিশীল জীবনদর্শন, যার গন্তব্য পূর্ণতার দিকে।

ধর্মের বহুবিধতা

ধর্ম’ শব্দটি হিন্দু সংস্কৃতিতে বহুবিধ ধারণা বহন করে:

  • আগুনের ধর্ম — দাহ করা,
  • জলের ধর্ম — নিম্নগামী হওয়া,
  • রাজার ধর্ম — ন্যায়বিচার,
  • পুত্রের ধর্ম — পিতার সেবা

এইভাবে, ধর্ম শুধু কোনও আধ্যাত্মিক অনুশাসন নয়, বরং এটি প্রাকৃতিক নিয়ম, ব্যক্তিগত কর্তব্য এবং সামাজিক সুনীতি — সব কিছুর সংহত রূপ

উপনিষদ ও গীতায় সনাতন সত্য

বিশিষ্ট পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বলেছেন, যেসব দার্শনিক সত্য চিরন্তন বা শাশ্বত অর্থ বহন করে সেগুলিকে সনাতন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

কঠোপনিষদে, মৃত্যুদেবতা যম আত্মার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন:

ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিন্নায়ং...
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে॥
আত্মা জন্মায় না, মরে না, শরীর বিনষ্ট হলেও সে বিনাশ হয় না

এটি হল সনাতন ধর্মের দর্শনমূল: আত্মা চিরন্তন, অবিনাশী

গীতায় একাধিকবার সনাতন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন:

ত্বমব্যয়ঃ শাশ্বতধর্মগোপ্তা, সনাতনস্ত্বং পুরুষো মতঃ মে॥
অর্থাৎ কৃষ্ণই অব্যয়, তিনি সনাতন ধর্মের রক্ষক, চিরন্তন পুরুষ

মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ॥
সমস্ত জীব ভগবানের অংশ, সেই অংশও সনাতনঅর্থাত্‍, আমাদের অন্তরের মধ্যে পরমাত্মাস্বরূপ যে চিত্‍কণা আছে তা সনাতন।

বীজং মাং সর্বভূতানাং বিদ্ধি পার্থ সনাতনম্॥

সমস্ত সৃষ্টির বীজ ভগবান। এটা সনাতন সত্য, কারণ ভগবান যদি সনাতন হন, তবে তার অংশভূত বীজও সনাতনই হবে।

হিন্দুশাস্ত্রের বহু শ্লোক শেষ হয়েছে এষ ধর্মঃ সনাতনঃ দিয়ে, যার অর্থ ইহাই সনাতন ধর্ম

যেমন, মনুসংহিতায় আছে:

সত্যং ব্রুয়াৎ, প্রিয়ং ব্রুয়াৎ, ন ব্রুয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্
প্রিয়ঞ্চ নানৃতং ব্রুয়াৎ — এষ ধর্মঃ সনাতনঃ॥
সত্য বলো, প্রিয় বলো, কিন্তু কষ্টদায়ক সত্য বলো না; প্রিয় কথা বললেও তা যেন মিথ্যে না হয় — এটাই সনাতন ধর্ম

মহাভারতের ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মতে, সনাতন ধর্মের মৌলিক উপাদান হল:

  • দয়া
  • ক্ষমাশীলতা (ক্ষমা পরম ধর্ম)
  • অনসূয়া (ঈর্ষা বা হিংসা থেকে মুক্ত)
  • অনৃশংসতা (অন্যের প্রতি নিষ্ঠুরতা না দেখান)

তিনি বলেন, দয়া শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এই দয়ার নীতিই ব্যক্তিগত আচরণ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পর্যন্ত বিস্তৃতনৃশংসতা মানে শুধু মারামারি, কাটাকাটিই নয়, কাউকে মনে আঘাত দেওয়া বা অসম্মান করাও নৃশংসতা। উত্‍কট অসাম্য সহ্য করাও নৃশংসতা। তিনি বলেন, ‘অবিনাশী নিত্যধর্মই সনাতন ধর্ম

সনাতন ধর্ম: এক জীবন্ত জীবনদর্শন

সনাতন ধর্ম কোনও একক মত নয়, এটি বহুমাত্রিক — তাতে আছে উপনিষদীয় জ্ঞান, বৈদিক আচরণ, পুরাণের কাহিনি, তন্ত্রের রহস্য, ভক্তির আবেগ এবং যোগের সাধনা। এর মূল সৌন্দর্য হল — এটি পরিবর্তিত সময়েও নিজেকে নবরূপে প্রকাশ করতে পারে, অথচ তার চিরন্তন সত্যকে অক্ষুণ্ণ রাখে

আজও হিন্দুধর্মের বহু সূত্রে — আচার, জ্ঞানচর্চা, দর্শনচিন্তা এবং মানবিক নীতিতে ‘এষ ধর্মঃ সনাতনঃ’ বাক্যটি প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়ে গেছে

উপসংহার: সনাতন ধর্ম — এক শাশ্বত যাত্রা

সনাতন ধর্ম’ কোনও এক নির্দিষ্ট মত নয়; এটি এক বহতা নদী — যা যুগে যুগে নিজের রূপ পাল্টালেও কখনও নিজের উৎসকে বিস্মৃত হয়নি। এই ধর্ম কেবল বিশ্বাসের অবলম্বন নয় — এটি এক জীবনপদ্ধতি, এক নৈতিক সাধনা, এক অন্তর্জাগতিক অনুশীলন

ড. রাধাকৃষ্ণনের মতে:

ধর্ম হল যা সমাজকে একত্র করে। যা বিভক্ত করে, তা ধর্ম নয়, অধর্ম।

এই সূত্রেই ‘সনাতন ধর্ম’ এক অতল সত্য — যা সময়ের সীমা পেরিয়ে এক চিরন্তন আত্মপরিচয়ে পরিণত হয়েছে 

Popular posts from this blog

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চেনার উপায়

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা — চন্দ্রসূর্যের মিলন ও বিরহ তিথি

তেলের সামাজিক মাহাত্ম্য

ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ

রাসলীলা মাহাত্ম্য

আঁধারের রূপ ও বিপন্নতা

আধ্যাত্মিকতা — পাশ্চাত্য ভাবধারার আলোকে

সূর্য উপাসনা

হৃদয়-দর্পনে দেখা