রবীন্দ্রনাথ — একদা পূর্ণিমায়
এক নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায় পদ্মার বুকে নৌকোঘরের ভিতর প্রদীপের আলোয় একটি বই পড়ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বইটি ছিল
সৌন্দর্যতত্ত্ব বিষয়ক। একজন
বিদেশী লেখকের লেখা। সৌন্দর্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা ছিল বইটিতে। যেমন, সৌন্দর্যের
স্বরূপ ও প্রকৃতি কী? সৌন্দর্য কি বস্তুর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, না কি মনের
মাধুরী মেশানো সুন্দর অনুভূতি মাত্র? সৌন্দর্য কি পরিমাপ করা
সম্ভব? সৌন্দর্য কি অঙ্গসৌষ্ঠব অর্থাৎ অঙ্গের বিভিন্ন অংশের
প্রতিসাম্য ও সমানুপাত দিয়ে নির্ধারণ করা সম্ভব? প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য কি মানুষের তৈরি সৌন্দর্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর?
সৌন্দর্য সম্বন্ধে পন্ডিতদের তত্ত্বকথা পড়তে পড়তে শ্রান্ত
হল কবির মন। তাঁর
মনে হল, সৌন্দর্য যেন শব্দবণিকের তৈরি কোনও জিনিস যা বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন
অলীক কোনও ধারণা।
হঠাৎ দমকা হাওয়ায় প্রদীপের শিখাটি কেঁপে কেঁপে নিভে গেল। আর অমনি তরল জোছনাধারায় সারা ঘর প্লাবিত হল। বিস্ময়াভিভূত রবীন্দ্রনাথ বলে উঠলেন — The spirit of Beauty, how could you, whose radiance
overbrims the sky, stand hidden behind a candle’s tiny flame? How could a few
vain words from a book rise like a mist, and veil her whose voice has hushed
the heart of earth into ineffable calm?1 হে পূর্ণচাঁদের দেবী, বিশ্বব্যাপিনী সৌন্দর্য-সত্তা,
যার দীপ্তি সমস্ত আকাশ কানায়-কানায় পূর্ণ করে রাখে, সেই তুমি, কেমন করে একটি প্রদীপের ছোট্ট শিখার পিছনে লুকিয়ে থাকতে পারলে? কীভাবে
একটি বই থেকে কিছু নিরর্থক উক্তি কুয়াশার মত উঠে তাকে ঢেকে রাখতে পারল, যার মৌনবাণী
পৃথিবীর হৃদয়কে অনির্বচনীয় প্রশান্তিতে স্তব্ধ করে দিয়েছে?
একটি ক্ষুদ্র বাতির ক্ষণিক শিখা এবং একটি গ্রন্থের কিছু
দুরুহ বাক্য জোছনাস্রোতকে যেন বাঁধ দিয়ে দৃষ্টির আড়ালে
রাখছিল। কিন্তু
যেমনি নিবল বাতি, মুহূর্তে অপসারিত হল সেই বাঁধ। জোছনাধারা
প্লাবনের মতো ঢুকে পড়ল খোলা দরজা-জানালা দিয়ে। কবি প্লাবিত হলেন সৌন্দর্য-উচ্ছ্বাসে, অভিভূত হলেন
পরমানন্দে। জয় হল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের।
সৌন্দর্য হচ্ছে শুদ্ধ আনন্দের উৎস। যা সৌন্দর্যময় তা
আনন্দময়। উপনিষদের কবি বলেছেন — ‘আনন্দে এই বিশ্বের উৎপত্তি, আনন্দে এর স্থিতি, আর আনন্দেই এর লয়।’ তাই
সৌন্দর্য উন্মোচন করা, সৌন্দর্যে নিবিষ্ট থাকা, এবং অবশেষে সৌন্দর্যে বিলীন হওয়াতেই মানবজনমের সার্থকতা। কারণ প্রাণীকুলে
একমাত্র মানুষের কাছেই সৌন্দর্য আসে আনন্দের দূত হয়ে। কিন্তু সৌন্দর্য কি কখনও ধরা
দেয় ক্ষুদ্র আলোয়, কিংবা তত্ত্বকথার শব্দমরীচিকাজালে? ▣
✍অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা