অলটেয়ার ও ভেগা: দুই নক্ষত্রের মিলন ও বিরহ

আপনি যদি এমন কোনও স্থানে বসবাস করেন, যেখানে রাতের আকাশ আলোক দূষণমুক্ত ও নিখাদ অন্ধকার, তাহলে নিশ্চয়ই দেখেছেন — আকাশজুড়ে ধূসরাভ একটি আলোকছায়ার বন্ধনী প্রসারিত হয়ে আছে। এটি আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সি — মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথ

এই ছায়াপথে রয়েছে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র, প্রতিটি এক একটি অগ্নিময় অস্তিত্ব, দূর আকাশের নিঃসীম নিস্তব্ধতায় ছড়িয়ে আছে। কিন্তু পৃথিবী থেকে তাদের একত্রে দেখলে তারা যেন গলে মিশে এক আশ্চর্য আলোর নদীতে রূপ নেয়। এই আলোর প্রবাহই বহু প্রাচীন সংস্কৃতিতে একটি স্বর্গীয় নদী রূপে কল্পিত হয়েছে — চিনে ‘ইন হে’ (রুপালি নদী), জাপানে ‘আমানোগাওয়া’ (স্বর্গের নদী), আর ভারতে — ‘আকাশগঙ্গা’

এই আকাশগঙ্গার দুই তীরে আলো ছড়িয়ে থাকে দুটি উজ্জ্বল নক্ষত্র — ভেগা (অভিজিৎ) ও অলটেয়ার (শ্রবণা)কিন্তু তারা শুধু জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তু নয়, বরং মানবমনের চিরন্তন প্রেম-তৃষ্ণার প্রতীক

milky way with altair and vega
আকাশগঙ্গা/ভেগা/অলটেয়ার

চিরায়ত এক প্রেমকাহিনি

প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে চিনে জন্ম নেয় এক লোককাহিনি। তাতে বলা হয়, ভেগা ও অলটেয়ার দুই মানবসন্তানের প্রতীক — জানু ও নিওলাং। জানু এক বয়নকন্যা, যে পিতার নির্দেশে বস্ত্র বোনে। নিওলাং এক সাদাসিদে রাখাল বালক, যে গরু চরায়। একসময় তারা প্রেমে পড়ে — গভীর, নিঃস্বার্থ, সর্বগ্রাসী প্রেম। সেই প্রেমে তারা এতটাই মগ্ন হয়ে পড়ে যে, নিজেদের দায়িত্ব অবহেলা করতে শুরু করে

এতে জানুর পিতা রুষ্ট হন। শাস্তিস্বরূপ তাদের দুজনকে রুপালি নদীর দুই তীরে নির্বাসন দেন। সেই থেকে জানু ও নিওলাং একে অপর থেকে দূরে — ভিন্ন ভিন্ন নক্ষত্র হয়ে বাস করছে আকাশগঙ্গার দুই পাড়েএই চিরবিচ্ছেদের পেছনে লুকিয়ে আছে চিরন্তন ভালবাসার গল্প। যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর পঙক্তির প্রতিধ্বনি —
“দুই তীরে তার বিরহ ঘটায়ে
সমুদ্র করে দান,
অতল প্রেমের অশ্রুজলের গান।”

এই অতল প্রেমই যেন ঘনীভূত হয়েছে অলটেয়ার ও ভেগার মধ্যকার বিরহে। আকাশগঙ্গা হয়ে উঠেছে এক বিষাদসিন্ধু — বিষাদের অশ্রুজলে টলমলাসেখানে বিরহের অন্তরালে সেতু বাঁধে মিলনের চিরন্তন আকুতি


tryst between zhinu and niulang
অভিসারে জানু ও নিওলাং

এই বিচ্ছেদ কেবল শাস্তি নয়, এক শুদ্ধিকরণ। প্রেমকে রক্ষা করার জন্যই তারা হয়ে ওঠে প্রতীক্ষার প্রতিমা। বছরে একটি মাত্র দিনে — চন্দ্র পঞ্জিকার সপ্তম মাসের সপ্তম সন্ধ্যায় তাদের মিলনের অনুমতি দেওয়া হয়। সেদিন এক ঝাঁক পাখি ডানা মেলে আকাশগঙ্গার উপর একটি সেতু তৈরি করে, যাতে জানু ও নিওলাং একদিনের জন্য মিলিত হতে পারে

এই একদিনের মিলন বহু শতাব্দী ধরে পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে — চিনে 'চি শি' (Qi Xi), জাপানে ‘তানাবাতা’। উৎসবের আবহে মানুষের হৃদয় জেগে ওঠে সেই প্রেমের টানে, যে প্রেম দৈহিক নয়, আধ্যাত্মিক; যার উৎস বিসর্জনে, আর পরিণতি প্রতীক্ষায়

প্রেম ও বিচ্ছেদ — এক অবিচ্ছেদ্য দ্বৈততা

এই কাহিনির মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাই প্রেমের এক উচ্চতর রূপ — যেখানে মিলনে নয়, বরং বিরহে হয় প্রেমের চরম প্রকাশ। কবি হেলাল হাফিজ যেমন বলেছেন, “ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল”। আসলে প্রেমের মিলনে থাকে বিচ্ছেদের আভাস, তাই মিলনের আনন্দ হয় ক্ষণিকের আর বিরহে থাকে মিলনের আকুতি, যা এক অদৃশ্য বন্ধনে চিরকাল বেঁধে রাখে দুই হৃদয়কেজানু ও নিওলাং আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রেম কেবল একত্রে থাকার মধ্যেই নয়, বরং দূরত্বের মাঝেও টিকে থাকে — স্মরণ, আকাঙ্ক্ষা ও প্রতীক্ষার মাধ্যমে

এখানে মিলন একটি ক্ষণ, বিরহ এক জীবন। এবং এই বিরহের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক অনিবার্য সৌন্দর্য — এমন সৌন্দর্য, যা কেবল দীর্ঘ প্রতীক্ষার মধ্য দিয়েই অনুভব করা যায়

রূপক ও ব্যাখ্যা

এই কাহিনি আমাদের শুধু প্রেম নয়, প্রেমে শুদ্ধতা, দায়িত্ব, আত্মত্যাগ ও সীমাবদ্ধতার পাঠ দেয়। জানু ও নিওলাং-এর প্রেম রূপক হয়ে দাঁড়ায় এমন সমস্ত সম্পর্কের জন্য, যেগুলি সামাজিক বা বাস্তব কারণে একত্র হতে পারে না, কিন্তু হৃদয়ে টিকে থাকে — স্মরণে, বিশ্বাসে ও মানসলোকে

ভেগা ও অলটেয়ার আমাদের বলে —
ভালবাসা মানে শুধু ছুঁয়ে থাকা নয়, বরং না ছুঁয়েও অনুভব করা।
এই প্রেমে নেই মালিকানা, নেই চাহিদা — আছে কেবল গভীর অনুরাগ, যাকে কখনও ত্যাগ, কখনও দূরত্ব, কখনও নীরবতা দিয়েও প্রকাশ করা যায়

উপসংহার: আকাশের গল্প, আমাদের হৃদয়ের ভাষা

অলটেয়ার ও ভেগার কাহিনি কেবল আকাশের গল্প নয়; এটি আমাদের নিজেদের গল্পও। আমরা প্রত্যেকে জানু বা নিওলাং — কেউ বা দায়িত্বের ভারে প্রেম বিসর্জন দিয়েছি, কেউ বা চিরপ্রতীক্ষায় থেকেছি কোনও দূরের তারার মতো এক হৃদয়ের জন্য

তবে এই কাহিনি শেষ হয় না বিরহে। এর শেষ হয় বিশ্বাসে। বিশ্বাস — যে একদিন সেতু গড়ে উঠবেই, হয়তো এক সন্ধ্যায়, হয়তো কেবল স্মরণেই

আর তখন বোঝা যায় —
স্মরণও এক প্রকার দেখা

প্রতীক্ষাও এক ধরণের মিলন

আকাশের দিকে তাকালে তাই দেখা মেলে শুধুই দুই নক্ষত্র নয়, দেখা মেলে দুই হৃদয়ের — একটি চিরন্তন সম্পর্কের, যা সময়, দূরত্ব ও নৈঃশব্দ্য পেরিয়েও অমলিন থাকে 

অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা 

Popular posts from this blog

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চেনার উপায়

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা — চন্দ্রসূর্যের মিলন ও বিরহ তিথি

তেলের সামাজিক মাহাত্ম্য

ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ

রাসলীলা মাহাত্ম্য

আঁধারের রূপ ও বিপন্নতা

আধ্যাত্মিকতা — পাশ্চাত্য ভাবধারার আলোকে

সূর্য উপাসনা

হৃদয়-দর্পনে দেখা