বাউল ভাব — এক অন্তর্গত ঈশ্বরের আরাধনা
আমরা যখন সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে কোনও প্রার্থনা বা অর্ঘ্য নিবেদন করি, তখন মনের অজান্তেই আমাদের
দৃষ্টি উপর দিকে চলে যায়। যেন, আমাদের
মাথার উপরে যে আকাশ, সেখানেই তিনি থাকেন।
কিন্তু পৃথিবীর সবদিকেই তো আকাশ, এবং ঘুর্ণায়মান পৃথিবী থেকে দেখা সেই আকাশের অবস্থান
পরিবর্তিত যাচ্ছে প্রতি মুহুর্তে। এমন অবস্থায়,
আকাশের কোনও নির্দিষ্ট
দিকে তাঁর অবস্থান নিরুপন করা কি সম্ভব? তাহলে কোন দিকে নিবেদন করব তাঁর প্রতি
আমাদের ভক্তি-অর্ঘ্য, কোথায় জনাব আমাদের প্রার্থনা, কোথায়ই বা তাঁর নিবাস?
সৃষ্টিকর্তা কোথায় থাকেন, সে সম্পর্কে একটি গল্প
প্রচলিত আছে। সেই গল্পে
আছে : সৃষ্টির প্রথম যুগে ঈশ্বর মানুষের বেশেই মানুষের সমাজে বাস করতেন, আর
মানুষের ভক্তি-ভালবাসায় সিক্ত হয়ে দিন কাটাতেন। কিন্তু এক সময় কিছু সমস্যা দেখা দিল। সমস্যা দেখা দিল মানুষের বহুবিধ দাবি পূরণ করতে গিয়ে। দাবির যেন শেষ নেই; এটা
পাওয়া হল তো ওটা চাই, ওটা পাওয়া হল তো ঐটা চাই। প্রতিদিন অজস্র সহস্র প্রার্থনা। কিন্তু তাতেও সমস্যা ছিল না, কারণ
তিনি তো সর্বশক্তিমান।
সমস্যা দেখা দিল অন্যত্র। ধরুন, একজন কৃষক প্রার্থনা করল, ‘হে
ঈশ্বর বৃষ্টি দাও, খরায় ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’ ঈশ্বর
বৃষ্টি দিলেন। তখন
ঘরের চাল ভাঙা থাকায় বৃষ্টিতে ভিজে গেল আরেক জনের বিছানা। সে প্রার্থনা করল, ‘হে ঈশ্বর, বৃষ্টি থামাও।’ একদল
লোক প্রার্থনা করল, অমুকের শাস্তি চাই। আরেকদল চাইল, না তাকে পুরস্কৃত করতে হবে। কিছু লোক চাইল একজনকে রাজা বানাতে, অন্যরা
চাইল অন্য একজনকে রাজা বানাতে। এ ধরনের
পরস্পর বিরোধী দাবি পূরণ করা ঈশ্বরের জন্য সত্যি কঠিন হয়ে দাঁড়াল। এক পর্যায়ে দিশেহারা হয়ে তিনি পালালেন, এবং লুকালেন
গিয়ে মানুষের হিয়ার মাঝে। সেই থেকে আজ অব্দি তিনি মানুষের হিয়ার মাঝে লুকিয়ে আছেন,
তাই মানুষ তাঁকে দেখতে পায় না।
অন্তরতম |
ঈশ্বর যে মানুষের হিয়ার মাঝে লুকিয়ে আছেন, এই খবরটি
কেমন করে যেন জেনে গেল বাংলার মরমি সাধক বাউল সম্প্রদায়ের লোকেরা। লালন বলল — ‘আপন ঘরে কে কথা কয়, না জেনে আসমানে তাকায়। ... কেবা কোথায়, বুঝিবে দিব্যজ্ঞানে’। তারা ভালবেসে এই ঈশ্বরের নাম দিল ‘মনের
মানুষ’, ‘সহজ
মানুষ’।
বাউলরা বিশ্বাস করে তাঁদের ‘মনের
মানুষ’ শুধু
বাউল-অন্তরেই বাস করে না; বাউল-অবাউল, জাত-পাত, দেশ-কাল নির্বিশেষে সকল মানুষের অন্তরেই সে বিরাজ করে। উপনিষদের কবির ভাষায়: ‘সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ’,
অর্থাৎ, ‘সকল জনের হৃদয়ে হৃদয়ে ইঁহারই আসন রাজে’। তাই, বাউলের ঈশ্বর সর্বজনের অন্তরের ‘মনের মানুষ’। আর এখানেই বাউল ভাবাদর্শের সর্বজনীনতা।
বাউলের ঈশ্বর হল ‘সহজ মানুষ’, কারন তার জন্য কঠিন সাধনার প্রয়োজন হয় না। সুদূর আকাশ কিংবা দুর্গম হিমালয়ের গুহায় তাকে অন্বেষণ
করতে হয় না। কারণ
সকল মানুষের হৃদি-মন্দিরে তার অধিষ্ঠান, সে থাকে মানুষের খুব কাছাকাছি। তাই তো তিনি সকলের কাছের মানুষ — মনের
মানুষ। আপন অন্তরে তার অস্তিত্ব অনুভব করার মধ্য দিয়ে শেষ
হয় তার অন্বেষণ। আর
অন্বেষণ যখন শেষ হয় তখন সাধনা পরিনত হয় আরাধনায়। ▣
✍অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা