আমিই সে — আমিই পরম সত্য
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে
মানুষ আজ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। তবু কি আধুনিক মানুষ
নিজেকে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্তা হিসেবে ঘোষণা করতে পেরেছে? অথচ হাজার বছর আগে উপনিষদের ঋষিরা সূর্যকে উদ্দেশ করে
বলেছিলেন, ‘হে দীপ্তিমান সূর্য, আমি
সেই পুরুষ, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ এই উক্তি থেকেই এসেছে ‘সোহম্’ বা ‘সোহং’, যার অর্থ,
‘আমিই সে’ বা ‘I am That’।
যীশু খ্রীস্ট বলেছিলেন, ‘আব্রাহামের আগে আমিই ছিলাম’ এবং ‘আমি আর পিতা এক’। পারস্যের সুফি
সাধক মানসুর আল-হাল্লাজ ধ্যানমগ্ন অবস্থায় উচ্চারণ করেছিলেন ‘আনাল হাক্ক’, অর্থাৎ ‘আমিই পরম সত্য’। বাংলার বাউল কবি
হাসন রাজার গানে পাওয়া যায়, ‘হাসন রাজায়
জিজ্ঞাস করে, কানাইয়া কোন জন। ভাবনা চিন্তা কইরা দেখি,
কানাই যে হাসন।’ অর্থাৎ, ‘আমিই কানাই, আমিই ঈশ্বর।’
যদি কেউ আজ বলে, ‘আমিই ঈশ্বর’, তাহলে
তাকে হয়তো অজ্ঞ বা অহংকারী বলে মনে হতে পারে। কিন্তু যাঁরা এসব কথা বলেছিলেন,
তাঁরা অজ্ঞ বা অহংকারী ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন দিব্যজ্ঞানী সাধক,
যাঁদের সাধনার মূল লক্ষ্য ছিল অহংকার ত্যাগ করে নিজেকে পরম সত্তার
কাছে সমর্পণ করা এবং পরম সত্তার সঙ্গে একাত্মতা লাভ করা।
এটি একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা
যাক। গণিতের একটি সূত্রে দেখা যায়, ∞ + ১ = ∞। অর্থাৎ, ‘ইনফিনিটি’ বা অসীমের সঙ্গে
কোনও সসীম সংখ্যার যোগফলও অসীম। ঈশ্বর সীমাহীন এবং অনন্ত। তিনি নিরাকার, সর্বব্যাপী। গণিতের নিয়মে অসীমের সঙ্গে যখন সসীম যুক্ত হয়, তখন সসীম তার স্বকীয়তা হারিয়ে অসীমে মিশে যায়। ঠিক তেমনি, কোনও সসীম সত্তা যখন পরম-সত্তার সঙ্গে একাত্ম হয়, তখন
তাদের মধ্যে আর কোনও পৃথকতা থাকে না।
মধ্যযুগের মরমি কবি কবীরের কথায়:
অর্থাৎ, তাঁকে খুঁজতে গিয়ে আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি; এক
ফোঁটা জল সাগরে মিশে গেলে তাকে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায় না।
নদী যখন মোহনায় সাগরের সঙ্গে মিশে যায়, তখন কি আর তার নিজস্ব নাম-পরিচয় থাকে? তখন নদীর সমস্ত পরিচয় মুছে গিয়ে তা সাগরের অংশ হয়ে যায়। একইভাবে, কোনও সাধক ধ্যান ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যখন পরম সত্তার সঙ্গে একাত্ম হন, তখন পরম সত্তাই তাঁর নতুন পরিচয় হয়। এই পর্যায়ে সাধক ও সাধ্য একাকার হয়ে যায়। ▣