অসহায় কেন মানবশিশু

মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হয় শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল অপরিণত অসহায় এক দেহ নিয়ে অন্যদিকে, নিম্নশ্রেনির জন্তুরা ভূমিষ্ঠকাল থেকেই হয় মানবশিশু অপেক্ষা অধিকতর পরিণত বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মানবশিশুর বৃহৎ মস্তকই এর কারণ

proportions of the head by leonardo da vinci

দ্য প্রপোরশনস অব দ্য হেড/লেওনার্দো দা ভিঞ্চি


একটু পিছন ফিরে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবেমানুষের মাথার আকার চিরদিন আজকের মত বৃহৎ ছিল না বিবর্তনের ধারায় সে-দিনের বনমানুষ যতই আজকের মানুষ হওয়ার দিকে এগিয়েছে ততই বেড়েছে তার মগজের পরিমান আর তার সঙ্গে বড় হয়েছে মাথার খুলিটাও মানুষের নিকটতম আত্মীয় শিম্পাঞ্জির কথাই ধরা যাক বর্তমানে একটি শিম্পাঞ্জির মগজের গড় ওজন হল ৩৮৪ গ্রাম আর একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মগজের গড় ওজন হল ১,৩৫২ গ্রাম, যা শিম্পাঞ্জির মগজের তুলনায় প্রায় তিনগুন বেশি ধারণা করা হয়, ৮০০ হাজার থেকে ২০০ হাজার বছর আগে মানুষের মগজের পরিমান দ্রুত বেড়ে যায়, আর সেই সঙ্গে বড় হয় মগজ রাখার পাত্রটি অর্থাৎ মাথার খুলি বা করোটি

মগজের পরিমান বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মস্তিস্ক আরও অনেক বেশী তথ্য প্রসেস করতে সক্ষম হল মানুষ বিমূর্ত চিন্তায় সক্ষম একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারল কিন্তু এর জন্য মানুষকে মূল্য দিতে হল, এবং আজও দিতে হচ্ছে

বিবর্তন প্রক্রিয়ায় মানুষের মস্তক বড় হল ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বড় হল না মানুষের জন্মদ্বার বা শ্রোণীচক্র (পেলভিক রিং) ফলে নবজাত শিশুর মাথার পরিধি আর মায়ের শ্রোণীচক্রের ব্যাসের মধ্যে দেখা দিল অসঙ্গতি সেই অসঙ্গতি মোকাবেলা করতে গিয়ে প্রকৃতি একটি সমাধান বের করল মানব শিশুকে ভূমিষ্ঠ হতে হল প্রকৃত সময়ের অনেক আগে অপরিনত মস্তিস্ক নিয়ে এক অসহায় নির্ভরশীল অস্তিত্ব হিসাবে শিম্পাঞ্জি বা অন্যান্য চতুষ্পদ স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই একটি বিড়ালছানা জন্মের পরপরই স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পারে এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রথম ইঁদুরটি ধরতে সক্ষম হয় অথচ একটি মানব শিশুর প্রথম পা-টি ফেলতে লাগে অনেক মাস, আর একটি সাধারণ কাজ শিখতে লাগে অনেক বছর

বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীরা বলেন — ‘The passage of the vagina through the pelvis is a sever historical constraint on the evolution of any further increase in fetal head size. This constraint, of having to fit an oversize head through the pelvis ring of bone, explains why human babies have to be born at such an early and vulnerable stage of development, compared to, for example, ape babies.’ অর্থাৎ, মায়ের গর্ভ থেকে মানবশিশুর নির্গত হওয়ার পথ অপ্রশস্ত শ্রোণীচক্রের ভিতর দিয়ে হওয়ায় ফলে ভ্রুণের মাথার আকার আর বড় হওয়ার সুযোগ থাকল না এই কারণেই মানবশিশুকে ভূমিষ্ঠ হতে হয় যথাসময়ের অনেক আগে, নিতান্ত নাজুক এক দেহ নিয়ে ধারণা করা হয়, চতুস্পদ জীবন ছেড়ে দু’পায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করায় মানুষের শ্রোণীচক্র আর বড় হতে পারেনি

তবে এসব হল বিবর্তনবাদীদের কথা কিন্তু যাঁরা সৃষ্টিবাদী ঈশ্বরকর্তৃক বিশ্বসৃষ্টিতে বিশ্বাস করেন, তাঁরা কি মানবেন, ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইন দিয়ে! ঈশ্বরের সৃষ্টিতে কি কোনও ত্রুটি থাকা সম্ভব? তবে তাঁরা নিশ্চয়ই মানবেন যে, এই ত্রুটিটুকুর কারণেই মানব শিশু জন্মগ্রহণ করে পিতামাতার উপর নির্ভরশীল হয়ে আজ পিতামাতা ও সন্তানসন্তুতির মধ্যে স্নেহ-ভালবাসার যে বন্ধন দেখতে পাই তা কি সম্ভব হত যদি এই নির্ভরশীলতাটুকু না থাকত?

প্রকৃতপক্ষে, পিতামাতার আশ্রয় না পেলে অসহায় মানবশিশুর পক্ষে টিকে থাকাই সম্ভব হত না অন্যান্য জন্তুর হামলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত মানব প্রজাতি পৃথিবী থেকে কিন্তু সেরকম অভিপ্রায় ঈশ্বরের ছিল না তাই তিনি অসহায় শিশুর রক্ষনাবেক্ষণ ও প্রতিপালনের জন্য পিতামাতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন আর দায়িত্ব পালনে যাতে অবহেলা না হয়, তা নিশ্চিত করতে পিতামাতার অন্তরে দিয়েছেন সন্তানের প্রতি অগাধ স্নেহ-ভালবাসা

একটি শিশু জন্মের পর থেকে অনেক দিন পর্যন্ত লক্ষ্য করে যে, তার সমস্ত প্রয়োজন মেটাতে কেউ না কেউ এগিয়ে আসে, তাকে দেখাশোনা করে, তার আহার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে সে বুঝতে পারে, তার একজন অভিভাবক রয়েছে, তার একজন প্রতিপালক রয়েছে ঈশ্বর কি এইভাবে একজন প্রতিপালকের ধারণার বীজ শিশুমনে বপন করতে চেয়েছেন, যাতে পরবর্তীতে একজন 'বিশ্বপ্রতিপালক'-এ বিশ্বাস স্থাপন করা সহজতর হয়!

হয়ত ঈশ্বরের অভিপ্রায় ছিল, মানবশিশু অপরিণত অবস্থায় পৃথিবীতে আসবে, আর তার সামনে থাকবে বিকাশের বহুবিস্তীর্ণ সুপরিসর প্রান্তর যে বিকাশ কয়েক বছরে, এমনকী, একজনমেও শেষ হবে না চলবে জনম জনম। 

অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা 

Popular posts from this blog

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চেনার উপায়

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা — চন্দ্রসূর্যের মিলন ও বিরহ তিথি

তেল মাহাত্ম্য

ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ

রাসলীলা মাহাত্ম্য

আঁধারের রূপ ও বিপন্ন অন্ধকার

আধ্যাত্মিকতা — পাশ্চাত্য ভাবধারার আলোকে

সূর্য উপাসনা

হৃদয়-দর্পনে দেখা