আরোগ্য সংগীত

সংগীতের নিরাময় ক্ষমতা: ঐতিহ্য ও ইতিহাস

মানুষ বহুকাল আগেই সংগীতের নিরাময় ক্ষমতা আবিষ্কার করেছিল। প্রাচীন গ্রিক ও মিশরীয় চিকিৎসকরা বাঁশি বা তারের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে রোগীর চিকিৎসা করতেন। প্রাচীন ভারতে কণ্ঠধ্বনির পুনরাবৃত্তি বা ‘চ্যান্টিং’ রোগ নিরাময়ের একটি উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হত। বাংলার ঐতিহ্যে সাপে কাটা রোগীর বিষ নামানোর সময় ওঝারা ঢাকের বাদ্য ও আদিরসাত্মক গান ব্যবহার করতেন।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও সংগীত থেরাপি

উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফ্রান্স, আমেরিকা ও রাশিয়ায় সংগীতের নিরাময় ক্ষমতা নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয়। গবেষণায় দেখা যায়, সংগীত রক্তচাপ কমায়, হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ায়, পালস-রেট কমায় এবং সাধারণভাবে দেহের ‘প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম’-এর কার্যক্রমকে সহায়তা করে। অর্থাৎ, সংগীত শুধু বিনোদন নয়, এটি সুস্বাস্থ্য ও নিরাময়ের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

আধুনিক সংগীত থেরাপি

বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মিউজিক থেরাপি নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। সংগীত, যা একসময় শুধুমাত্র নিরাময়-কলা হিসেবে বিবেচিত হত, তা এখন নিরাময়-বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। কেউ মনে করেন, শুধুমাত্র বাদ্যযন্ত্রের সুর নিরাময়ে কার্যকর, আবার কেউ মনে করেন, সুরেলা কণ্ঠস্বরও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

Music heals

সংগীতের নিরাময় প্রক্রিয়া

সংগীতের নিরাময় প্রক্রিয়া অনেকটা তারের বাদ্যযন্ত্রের কার্যক্রমের মতো। যেমন সারেঙ্গী বা সেতারে মুখ্য তার ও সহায়ক তার একসঙ্গে অনুরণিত হয়ে সুর সৃষ্টি করে, তেমনিভাবে সংগীতও মানুষের দেহে সমবেদী কম্পন সৃষ্টি করে, যা নিরাময়ে সহায়ক হতে পারে। বিজ্ঞানীরা একে ‘সিম্প্যাথেটিক রেজোন্যান্স’ বা সমবেদী অনুরণন বলে থাকেন। উল্লেখ্য, তারের বাদ্যযন্ত্রে সহায়ক তার সরাসরি বাজানো হয় না, মুখ্য তারে বাজানো ধ্বনি অনুরণিত হয় সহায়ক তারে

মেলোডিক ইনটোনেশন থেরাপি

সত্তরের দশকে মার্কিন স্নায়ুবিজ্ঞানী মার্টিন আলবার্ট এবং বাক্-রোগবিজ্ঞানী রবার্ট স্পার্ক্স ও ন্যান্সি হেল্ম মিলে ‘মেলোডিক ইনটোনেশন থেরাপি’ (সুরেলা স্বরভঙ্গি দিয়ে চিকিৎসা) নামক একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এই থেরাপির মাধ্যমে স্ট্রোক বা মস্তিষ্কজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা ধীরে ধীরে স্বাভাবিকভাবে কথা বলার ক্ষমতা ফিরে পান।

রবীন্দ্রনাথ ও সংগীতের নিরাময় ক্ষমতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় গীতসুধারসে এসো’ এবং ‘মরণ থেকে যেন জাগি গানের সুরে’। কিন্তু গানের সুর কীভাবে মানুষকে সজীব করবে কিংবা মরণ থেকে জাগাবে? বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সংগীত নিজস্ব ভৌত গুণের মাধ্যমেই নিরাময়ে কাজ করে, রোগীর ব্যক্তিগত অনুভূতি ছাড়াই। তাঁরা সংগীতকে মনে করেন ওষুধ। ওষুধ তেতো না মিঠা তাতে কিছু আসে যায় না, ওষুধের রাসায়নিক গুণ রোগ নিরাময় করে। তেমনি কোনও গান রোগীর ভাল লাগুক বা না লাগুক সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সংগীতের ভৌত গুণের কারণেই রোগ নিরাময় হবে, এমনটিই তাঁদের ধারণা।

তবে, রোগীর পছন্দের গান ব্যবহার করলে আরও ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে। আর গানের কথা ও সুর যদি হয় নিরাময় সহায়ক তা হলে সে গান হবে আদর্শ নিরাময় সংগীত

নিরাময় সংগীত ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা

গানের নিরাময় ক্ষমতা নির্ভর করে শ্রোতার অভিজ্ঞতা ও মানসিক অবস্থা অনুযায়ী গানের অর্থ ব্যাখ্যার উপর। কোনও গান যদি রোগীর মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং দেহের স্বাভাবিক নিরাময় প্রক্রিয়াকে উদ্দীপিত করে, তবে সেটিই হয়ে ওঠে আদর্শ নিরাময় সংগীত। নির্দিষ্ট কোনও গানের নিরাময় ক্ষমতা সব মানুষের জন্য সমানভাবে কার্যকর নাও হতে পারে, তবে সাধারণভাবে বলা যায়, নিরাময় সহায়ক রাগরাগিণী ও ভাবসম্পন্ন গান অধিকাংশ মানুষের জন্য উপকারী হতে পারে।

নিরাময় সংগীতে রবীন্দ্রসংগীতের অবদান

রবীন্দ্রসংগীতের মধ্যে অনেক নিরাময় সহায়ক গান পাওয়া যায়, যেমন — ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো’, ‘তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ থেকে যেন জাগি গানের সুরে’, ‘অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ’, ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’, ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ’, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে, যে-কোনও প্রার্থনাসংগীতই নিরাময়ে সহায়ক হতে পারে।

উপসংহার

মানুষের দেহ ও মন সংগীতের তাল-লয়-ছন্দের সঙ্গে সংযুক্ত। যখন এই ঐকতান নষ্ট হয়, তখন অসুস্থতা দেখা দেয়। আবার, সংগীতের সুমধুর সুর ও অনুরণনশীল প্রভাবের মাধ্যমে মানুষ সুস্থতা ফিরে পেতে পারে। তাই, সংগীত শুধুমাত্র বিনোদন নয়, এটি হতে পারে এক মহৌষধ, যা মানুষকে আরোগ্যের পথে নিয়ে যেতে সক্ষম। 


অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা 

Popular posts from this blog

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চেনার উপায়

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা — চন্দ্রসূর্যের মিলন ও বিরহ তিথি

তেলের সামাজিক মাহাত্ম্য

ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ

রাসলীলা মাহাত্ম্য

আঁধারের রূপ ও বিপন্নতা

আধ্যাত্মিকতা — পাশ্চাত্য ভাবধারার আলোকে

সূর্য উপাসনা

হৃদয়-দর্পনে দেখা