নৈঃশব্দ্য সংগীত
মানুষ যে ভাষায় কথা বলে তা সংকীর্ণ অর্থের গন্ডিতে
বাঁধা। এই ভাষা মানব মনের গভীরতর আবেগ-অনুভূতি সঠিকভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম নয়। ‘ভালবাসি’ শব্দটির কথাই ধরা যাক। আমরা
ফুল ভালবাসি, প্রিয়জনকে ভালবাসি, ঈশ্বরকেও ভালবাসি। কিন্তু সব ভালবাসা কি একরকম হয়? ভালবাসার মাত্রা প্রকাশ করতে আমরা ‘বেশি’, ‘আরও বেশি’, ‘সবচেয়ে বেশি’ ইত্যাদি
শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে থাকি।
কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভালবাসা প্রকাশের ভাষা আমাদের শব্দভাণ্ডারে নেই। ভাষার
এই সীমাবদ্ধতা কিছুটা অপসারিত হয় যখন ভাষার সঙ্গে যুক্ত হয় ছন্দ ও সুর; সৃষ্টি হয় কবিতা ও গান।
পৃথিবীতে ছন্দ-সুর প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল মহর্ষি
বাল্মীকির বেদনায় বিদারিত অন্তরে। তখন
তিনি বলেছিলেন, ‘মানবের জীর্ণ বাক্যে মোর ছন্দ দিবে
নব সুর, অর্থের বন্ধন হতে নিয়ে তারে যাবে কিছু দূর।’ মানুষের ভাষা অর্থের বন্ধনে বাঁধা।
ভাষাকে ধরাবাঁধা অর্থের বন্ধন হতে মুক্ত করে নতুনতর অর্থ প্রদানের উদ্দেশ্যেই
ভাষার সঙ্গে যুক্ত হয় সুর। বাণী ও সুরের মেলবন্ধনে সৃষ্টি হয় গান। বাণী
ও সুরের ডানায় ভর করে মনের ভাব পায় আরও কিছুদূর উড়িবার আকাশ।
তবে বাণী ও সুরের ভাব-প্রকাশ করার ক্ষমতা সীমাহীন নয়। মনের ভাব গভীরতর হতে থাকলে একসময় তা প্রকাশে বাণী আর যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারে না। তখন মনের ভাব বাণীনির্ভরতা কাটিয়ে হয় শুধুই সুরাশ্রয়ী। গান পরিণত হয় গানের আলাপে। কোনও অর্থবিশিষ্ট বাণী আর থাকে না, থাকে কেবল মুক্ত সুরের লীলা। গান উন্নীত হয় উচ্চতর পর্যায়ে।
অবশেষে আসে মনের গভীরতম ভাবটি প্রকাশের পালা।
গভীরতম আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করা বাণী ও সুর উভয়েরই
সাধ্যের অতীত। তাই তখন গান থেকে অপসৃত হয় বাণী ও সুর। গানে
থাকে শুধু নৈঃশব্দ্য। নৈঃশব্দ্য গানের চেয়ে অনেক বেশি সংগীতময়। তাই সৃষ্টি
হয় নৈঃশব্দ্য-সংগীত।
সুরবাণীর অতীত যে গান তার নাম নৈঃশব্দ্য সংগীত। এই
সংগীত শুদ্ধতম ও উচ্চতম সংগীত। নৈঃশব্দ্য-সংগীত সবচেয়ে আদি ও মৌলিক সংগীতও বটে। শব্দ-সংগীতের বহু আগে থেকে এই সংগীত রচিত হয়ে আসছে।
প্রেমের গভীরতম পর্যায়ের নাম ‘ভক্তি’। নৈঃশব্দ্য-সংগীত ভক্তিভাব প্রকাশের সংগীত। এই
সংগীতের মাধ্যমে বাঙ্ময় মৌন ঈশ্বর, এই সংগীতের মাধ্যমে মৌনমুখর নির্বাক
গ্রহ-নক্ষত্র ও বিশ্ব-প্রকৃতি। ▣
✍অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা