অগ্রহায়ণ — নববর্ষ থেকে নবান্ন
‘ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে
আমি কী দেখেছি মধুর হাসি, আমার সোনার বাংলা।’ রবীন্দ্রনাথ যে সোনার বাংলার কথা বলেছেন তা মূলত অঘ্রানের বাংলা। কারণ অঘ্রান
মাসে বাংলার উর্বর জমিতে সোনা ফলে। বাংলার মাঠ ছেয়ে যায় সোনালি ধানে। পরনে সোনালি
পরিধান, মুখে মধুর হাসি — মায়ের এই
অপরূপ রূপ দেখে বাঙালির আনন্দের সীমা থাকে না।
অগ্রহায়ণ বাঙালির জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (১৫৪০-১৬০০) বলেছেন — ‘ধন্য অগ্রহায়ণ মাস, ধন্য অগ্রহায়ণ মাস। বিফল জনম তার, নাই যার চাষ।’ এই মাসে কৃষক ঘরে তুলে বছরের প্রধান শস্য আমন ধান। ঘরে ঘরে ধুম পড়ে আনন্দ উৎসবের। নতুন ধানের নতুন চালে তৈরি হয় নবান্ন, মিষ্টান্ন। বাংলার কৃষক মেতে উঠে উৎসবের আনন্দে।
একদিন অগ্রহায়ণ ছিল বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। নামেও তা স্পষ্ট। ‘অগ্র’ মানে প্রথম, ‘হায়ন’ মানে বছর। অর্থাৎ ‘হায়ন’ বা বছরের প্রারম্ভে থাকে যে মাস তার নাম অগ্রহায়ণ। অতীতে আমাদের নববর্ষের দিন ছিল পহেলা অগ্রহায়ণ।
বৈশাখ কবে থেকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে গণ্য হল, সে বিষয়ে সামান্য মতানৈক্য রয়েছে। তবে অনেক
ঐতিহাসিক মনে করেন, ৯৬৩ হিজরিতে যখন ‘ফসলি সন’ বা ‘বাংলা সন’
প্রবর্তন করা হয়, তখন হিজরি সনের প্রথম মাস
মহররম বৈশাখ মাসের সঙ্গে মিলে যায়। তাই এ দেশে
পহেলা বৈশাখই নববর্ষ হিসেবে গণ্য করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে, শরত, হেমন্ত, বসন্ত ঋতু নববর্ষ উদযাপনের জন্য বিশেষ
উপযুক্ত। কারণ এই সময় প্রকৃতি ফুল, ফল, শস্যে পরিপূর্ণ থাকে। পারসি
সংস্কৃতিতে ‘নওরোজ’ বা
নববর্ষ উদযাপিত হয় ‘ভার্নাল ইকুইনক্স’ বা
বসন্তের প্রথম দিন। প্রায় তিন হাজার বছর যাবত চলে আসছে এই প্রথা।
বহু আগে বাংলাতেও নববর্ষ উদযাপিত হতো বসন্ত ঋতুতে। বিশিষ্ট গবেষক, লেখক যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেছেন, ‘প্রাচীনকালে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে নববর্ষের উৎসব হতো। দোলযাত্রা বা
হোলি সেই উৎসবেরই চিহ্ন বহন করে।’