শূন্য করিয়া রাখ তোর বাঁশি

বাঁশের বাঁশি

বাঁশি কেবল বাঁশেরই হয়, কাঠের নয়। বাঁশি হতে হলে তার অভ্যন্তর ফাঁকা থাকতে হয়, থাকতে হয় ছিদ্র, যেখান দিয়ে সুরের প্রবাহ ঘটে। ছিদ্রবিহীন বাঁশি কখনওই প্রকৃত বাঁশি নয়; এটি মূলত ফুঁ দিয়ে বাজানোর যন্ত্র

একটি বাঁশিতে থাকে ছয়টি ছিদ্র, যা মানুষের দুই চোখ, দুই কান এবং দুই নাসার প্রতিরূপ। এ ছাড়াও থাকে একটি বড় ছিদ্র, যা প্রতীকীভাবে মুখের মতো। এই মুখ ছিদ্রটি কম্পমান ঠোঁটের স্পর্শে স্পন্দিত হয়। তাই বাঁশিকে মানুষের প্রতীক হিসেবেও কল্পনা করা হয়

bamboo flute

বাঁশি ও ঈশ্বর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইংরেজি গীতাঞ্জলি-তে তাঁর আধ্যাত্মিক যাত্রা বাঁশির প্রতীকী কল্পনা দিয়ে শুরু হয়। ঈশ্বর এখানে এক বাঁশিবাদক, আর কবি নিজেকে কল্পনা করেছেন তাঁর হাতে ধরা এক বাঁশি হিসেবে

‘You have made me endless; such is Your pleasure. This frail vessel You empty again and again, and fill it ever with fresh life.
This little flute of a reed You have carried over hills and dales and have breathed through it melodies eternally new.’

বাংলায় কবির কণ্ঠে —

আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব –
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব॥
কত-যে গিরি কত-যে নদী-তীরে
বেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে,
কত-যে তান বাজালে ফিরে ফিরে
কাহারে তাহা কব॥

বাঁশি ও জীবন

প্রত্যেক মানুষ যেন এক-একটি বাঁশি, যেখানে চলে প্রাণবায়ুর প্রবাহ — ফুরিয়ে যাওয়া ও পূর্ণ হওয়ার এক অনন্ত খেলা। যেমন বাঁশির ছিদ্র দিয়ে দম ভরে উঠে সুরের সৃষ্টি হয়, তেমনই মানুষের দেহেও প্রবাহিত হয় জীবনের তরঙ্গ

তবে এক রহস্য থেকে যায় — বাঁশি দৃশ্যমান, কিন্তু বাঁশিবাদক অদৃশ্য। তিনি আমাদের চক্ষুর অন্তরালে বাস করেন। তাঁকে জানা না গেলেও কোনও ক্ষতি নেই; আমাদের কেবল দরকার হৃদয়কে শূন্য রাখা। কারণ, হৃদয় যদি আকাশসম মুক্ত না হয়, তবে বাঁশিও বাজবে না

কবি তাই বলেছেন —

শূন্য করিয়া রাখ তোর বাঁশি, বাজাবার যিনি বাজাবেন আসি।

সাধনার পরম লক্ষ্য

বাঁশির জীবনে যে সুর ও সংগীত সৃষ্টি হয়, তার কৃতিত্ব বাঁশির নয়, বরং সেই অদৃশ্য বাঁশিবাদকের। তাঁরই ইচ্ছা আমাদের জীবনে বিচিত্র রূপে প্রকাশ পায়

বাঁশি বলে, মোর কিছু নাহিকো গৌরব,
কেবল ফুঁয়ের জোরে, মোর কলরব।
ফুঁ কহিল, আমি ফাঁকি, শুধু হওয়াখানি—
যে জন বজায় তারে কেহ নাহি জানি।

এই বাঁশিবাদককে জানা যায় না, তবু একদিন জীবনাবসান ঘটে — বাঁশির সুর থেমে যায়, দীপের শিখা নিভে যায়, পড়ে যায় যবনিকা

বাঁশি যখন থামবে ঘরে,
নিববে দীপের শিখা,
এই জনমের লীলার ’পরে
পড়বে যবনিকা।

মানুষের সাধনা হল সত্যিকারের বাঁশি হয়ে ওঠা — অহংকার, লোভ, হিংসা-দ্বেষ, এবং সমস্ত বিষয়-বাসনা বিসর্জন করে হৃদয়কে শূন্য করে রাখা। তাহলেই বাঁশি বাজবে। যিনি বাজাবার, তিনিই বাজাবেন — তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হবে আমাদের হৃদয়ের মাঝে 


Popular posts from this blog

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চেনার উপায়

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা — চন্দ্রসূর্যের মিলন ও বিরহ তিথি

তেলের সামাজিক মাহাত্ম্য

ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ

রাসলীলা মাহাত্ম্য

আঁধারের রূপ ও বিপন্নতা

আধ্যাত্মিকতা — পাশ্চাত্য ভাবধারার আলোকে

হৃদয়-দর্পনে দেখা

সূর্য উপাসনা