উপনিষদ প্রসঙ্গ
মানব সভ্যতার ঊষালগ্নে মানুষ বারবার
একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিল —এই সৃষ্টি কোথা থেকে এসেছে? এর নেপথ্যে কোন শক্তি কাজ করছে? দৃশ্যমান শক্তিগুলোর উৎস কোথায়? এই গভীর জিজ্ঞাসাগুলির
উত্তর খুঁজতে প্রাচীন ঋষিরা মুক্তবুদ্ধি ও স্বজ্ঞার আলোকে অনুসন্ধান করেছিলেন।
তাঁদের সেই অনুসন্ধানের ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল এক অনন্য দর্শন-সাহিত্য — উপনিষদ।
উপনিষদ সম্পর্কে প্রখ্যাত জার্মান
দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ার (১৭৮৮–১৮৬০) বলেছেন, ‘উপনিষদের প্রত্যেক বাক্য থেকে গভীর, মৌলিক এবং উন্নত
চিন্তা পাওয়া যায়। এই গ্রন্থগুলো পবিত্র এবং আন্তরিকতার আবেশে পরিব্যাপ্ত।
পৃথিবীতে উপনিষদের মতো আর কোনও গ্রন্থ নেই যা পাঠ করে এত কল্যাণ ও উৎকর্ষ লাভ করা
সম্ভব। এগুলি সর্বোচ্চ জ্ঞানের ফল এবং একদিন মানবধর্মে এদের স্থান নিশ্চিত হবে।’
উপনিষদ রচিত হয় সংস্কৃত ভাষায়। এর
রচয়িতা ঋষিরা ছিলেন একাধারে চিন্তাবিদ ও কবি। তাঁদের রচনা দর্শন-কাব্যের উদাহরণ।
প্রাচীনতম উপনিষদগুলির রচনা খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যে সম্পন্ন
হয়। পরবর্তীতেও উপনিষদ রচনার ধারা অব্যাহত ছিল। মনে করা হয়, মোট একশো বারোটি উপনিষদ রয়েছে, তবে
এর মধ্যে তেরোটি ‘ধ্রুপদি’ উপনিষদ হিসেবে স্বীকৃত। এগুলি হল: ঐতরেয়, কৌষীতকি, ছান্দোগ্য, তৈত্তিরীয়,
বৃহদারণ্যক, কেন, কঠ,
শ্বেতাশ্বতর, ঈশ, প্রশ্ন,
মুন্ডক, মান্ডুক্য ও মৈত্রী।
উপনিষদের দর্শন
হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিক চিন্তা ও
দর্শনের মূল ভিত্তি হল উপনিষদ। তবে এর ভাবনা সরাসরি প্রকাশিত নয়; বরং নিগূঢ় রহস্যে আচ্ছাদিত এক গভীর জ্ঞান। যেমন,
তৈত্তিরীয় উপনিষদে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে —
‘কী এই বিশ্ব? কী থেকে এর উৎপত্তি? কোথায় তা চলছে?’
উত্তরে বলা হয়েছে—
‘আনন্দ থেকেই এর উৎপত্তি, আনন্দেই এর
স্থিতি, আর আনন্দেই এর লয়।‘
কী গভীর অর্থ বহন করে এই বাক্য!
উপনিষদের বাক্যগুলো একধরনের
ইঙ্গিতমাত্র, ঠিক যেমন আঙুল দিয়ে চাঁদ দেখানো।
আঙুল দেখেই সন্তুষ্ট হলে চাঁদ দেখা হয় না। তেমনি উপনিষদের গভীর অর্থ উপলব্ধি করতে
হলে শব্দের সাধারণ অর্থ পেরিয়ে ভাবার্থ অনুধাবন করতে হয়।
উপনিষদে আত্মা ও ব্রহ্ম সম্পর্কে বলা
হয়েছে — আমাদের চারপাশের সবকিছু এক শুদ্ধসত্তার বিভিন্ন রূপ মাত্র। এই শুদ্ধসত্তা
হল ব্রহ্ম, যা আত্মা নামে পরিচিত। আত্মা
সর্বত্র বিরাজমান। ঈশ্বরের আত্মা এবং জীবের আত্মা একই সত্তার প্রকাশ। এই হল উপনিষদের
মূল দর্শনতত্ত্ব।
একটি বীজমন্ত্রে এই ধারণা সুন্দরভাবে
প্রকাশিত:
‘ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।’
অর্থাৎ, ‘পূর্ণ ঐ, পূর্ণ
এই। পূর্ণ থেকে পূর্ণ উদ্ভূত হয়। পূর্ণের পূর্ণ গ্রহণ করলেও পূর্ণই অবশিষ্ট থাকে।’
যেমন প্রদীপের শিখা থেকে আরও অনেক
প্রদীপ জ্বালালে মূল শিখার কোনও ক্ষতি হয় না, তেমনি পরমাত্মা থেকে অসংখ্য জীবাত্মা সৃষ্টি হলেও পরমাত্মার পূর্ণতা অটুট
থাকে।
উপনিষদের আধুনিক তাৎপর্য
উপনিষদের আধ্যাত্মিক শিক্ষার
প্রাসঙ্গিকতা আজও অটুট।
1. মানবিক সমন্বয়:
আত্মতত্ত্বের অনুশীলন করে কেউ যদি নিজের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করেন,
তবে তিনি দেখবেন পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যে একই আত্মার প্রকাশ। এতে
দেশ, জাতি, ধর্ম, শ্রেণি ও বর্ণভেদ ভুলে এক অপূর্ব ঐক্যের বোধ জেগে উঠবে। এই চেতনা
হিংসা-দ্বেষহীন, ভালবাসাভিত্তিক আধ্যাত্মিক গণতান্ত্রিক সমাজ
প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।
2. মানব ও প্রকৃতির একত্ব:
আত্মার অভিন্নতা উপলব্ধি করলে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যেকার ব্যবধান
ঘুচে যায়। এই জ্ঞান মানুষকে প্রকৃতিকে ভালবাসতে এবং তা সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করে।
3. মৃত্যুভয়ের পরিত্রাণ:
আত্মার অবিনশ্বরতার ধারণা মৃত্যুভয় ও প্রিয়জন হারানোর শোক থেকে
মুক্তি দেয়। উপনিষদ মানুষকে দৈনন্দিন জীবনের ক্ষুদ্রতা থেকে উর্ধ্বে নিয়ে যায় এক
মহত্তর বাস্তবতায়। সম্ভবত এই কারণেই শোপেনহাওয়ার বলেছেন, ‘উপনিষদ পাঠ করে আমি জীবনে সান্ত্বনা পেয়েছি, মৃত্যুতেও
এই সান্ত্বনাই পাব।’
উপনিষদের এই জ্ঞান শুধু প্রাচীন কালের উত্তরাধিকার নয়, বরং আধুনিক মানবসমাজের জন্য এক অনন্য সম্পদ। ▣