হৃদয়াকাশ ও অসীম আকাশ
ভূপৃষ্ঠের ঊর্ধ্বে বায়ুমণ্ডল ও
মহাশূন্যসহ সমস্ত বিস্তৃত ক্ষেত্রই আকাশ। আকাশ পৃথিবীকে বেষ্টন করে রেখেছে।
কবিগুরুর ভাষায়, ‘আকাশ ধরারে বাহুতে বেড়িয়া
রাখে, তবুও আপনি অসীম সুদূরে থাকে।’ পৃথিবীর চারপাশে আকাশ অসীম সুদূর পর্যন্ত প্রসারিত।
আকাশ অনন্ত ও সীমাহীন। এর নেই কোনও
কিনারা, নেই কোনও নির্দিষ্ট দিক। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, ‘আকাশে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে কোনও প্রভেদ নেই; মানুষ
মনের মধ্যে প্রভেদ সৃষ্টি করে এবং তা বিশ্বাস করে।’
আকাশ যেন এক বিশাল প্রেক্ষাপট, যেখানে দিনরাত মেঘ, সূর্য,
চাঁদ ও তারাদের অপূর্ব চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এই দৃশ্যাবলী এতই
বৈচিত্র্যময় যে কখনও পুরোনো মনে হয় না; বরং তা মানুষের মনে
চিরকালীন আনন্দ এনে দেয়। কবির কথায়, ‘জানিস কি রে কত যে
সুখ, আকাশ-পানে চাহিলে পরে, আকাশ পানে
তুলিলে মুখ।’
চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র — সবই আকাশেরই অংশ। আকাশেই
তাদের জন্ম, আকাশেই তাদের অবস্থান। এমনকী পৃথিবীরও জন্ম
আকাশেই, এবং তার অস্তিত্বও আকাশেই বিরাজমান। অর্থাত্ আমাদের
সবার উৎস এক, পরিণতিও এক। তাই আমরা আকাশকে উপাসনা করব,
তার অভিমুখে মঙ্গল প্রার্থনা করব।
মানুষের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে এক পদ্মাকৃতির ক্ষুদ্র গৃহ আছে, যাকে বলা হয় হৃদয়পদ্ম বা শুধু হৃদয়। ফরাসি সাহিত্যিক ভিক্টর হুগো বলেছেন, ‘একটি দৃশ্য আছে যা সাগরের চেয়ে বড়, তা হচ্ছে আকাশ; একটি দৃশ্য আছে যা আকাশের চেয়ে বড়, তা হচ্ছে হৃদয়ের অভ্যন্তর।’ রবীন্দ্রনাথ এই হৃদয়কে বলেছেন হৃদয়াকাশ — ‘দোলে প্রেমের দোলন-চাঁপা হৃদয়-আকাশে।’
আকাশের আরেক নাম অন্তরীক্ষ। এই শব্দটি ‘অন্তর্’ ও ‘ঈক্ষ্’ ধাতুর সংযোগে গঠিত, যেখানে
"ঈক্ষ্" অর্থ দেখা। অর্থাৎ, অন্তর দেখা ও আকাশ
দেখার মধ্যে এক অনন্য সংযোগ রয়েছে, যা হৃদয়-আকাশের
অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়।
ছান্দোগ্য উপনিষদে হৃদয়াকাশের কথা বলা
হয়েছে —
‘বাহিরের আকাশ যত বড়,
হৃদয়ের অভ্যন্তরস্থ আকাশও তত বড়। এর মধ্যেই নিহিত স্বর্গ ও পৃথিবী,
অগ্নি ও বায়ু, সূর্য ও চন্দ্র, বিদ্যুৎ ও নক্ষত্র, এবং দেহবান আত্মার ইহলোকে যা আছে
ও যা নেই, সেই সমস্ত। দেহ বিনষ্ট হলেও অন্তরস্থ আকাশ কখনও
নষ্ট হয় না।’
অর্থাৎ, বাইরের আকাশে যা আছে, হৃদয়াকাশেও তাই প্রতিফলিত হয়।
প্রেম, ভক্তি, সুখ, আনন্দ — যা কিছু আমরা চাই, তার উৎস আমাদের হৃদয়ের
গভীরে। হৃদয়াকাশে যা চাওয়া হয়, সংকল্প মাত্র তা আমাদের কাছে
উপস্থিত হয়।
কোনও প্রিয়জন ইহলোক থেকে বিদায় নিলে
আমরা তাকে চোখে দেখি না। যারা বহু দূরে অবস্থান করছে, তারাও দৃষ্টির অন্তরালে থাকে। কিন্তু হৃদয়াকাশে তাদের
অনুভব করা যায়, দেখা পাওয়া যায়।
শেষ পর্যন্ত, যিনি আকাশাত্মা, তিনিই আমাদের হৃদয়ের আত্মা। তিনি চেতনাময়, প্রাণ যার শরীর। তিনি সর্বত্র বিরাজমান; তিনিই আমাদের হৃদয়ের ঈশ্বর। আকাশকে হৃদয়ের ঈশ্বররূপে উপাসনা করলে হৃদয়াকাশে আনন্দপূর্ণিমা উদ্ভাসিত হয়। ▣