বাড়ি বদল

গভীর রাতে এক চোর গৃহস্থের বাড়িতে সিঁধ কেটে প্রবেশ করল। গৃহকর্তা ঘুমিয়ে ছিলেন — আসলে, না। তিনি ঘুমের ভান করছিলেন। চোখের পাতা সামান্য ফাঁক রেখে লক্ষ করছিলেন চোরের কার্যকলাপ। তিনি অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ করতে অভ্যস্ত নন, আর চোরও তো তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না! তাহলে কেন তিনি চোরের কাজে বাধা দেবেন? চোরকে তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে দেওয়াই ভাল

তবে গৃহকর্তার কাছে চোরকে কিছুটা অদ্ভুত মনে হচ্ছিল। সে ঘরের সব জিনিসপত্র একে একে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে কিছু হাত থেকে পড়ে শব্দও হচ্ছে। তবু গৃহকর্তা নির্বিকার। একসময় তাঁর মনে হল, এমন নিঃশব্দ ঘুম তো তখনই সম্ভব যখন কেউ সত্যিই জেগে ঘুমায়! কী আশ্চর্য মানুষ! কিছু বলছে না, প্রতিবাদও করছে না!

চোর সবকিছু গুছিয়ে ঠেলাগাড়িতে তুলে বাড়ির দিকে রওনা হল। হঠাৎ তার মনে হল, কেউ তার পিছু নিয়েছে। পিছন ফিরে দেখল — এই সেই মানুষ, যিনি এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিলেন। চোর বিস্মিত হয়ে বলল, ‘তুমি কেন আমার পিছু নিচ্ছ?’

গৃহকর্তা শান্ত স্বরে বললেন, ‘আমি তোমার পিছু নিচ্ছি না, বাড়ি বদল করছি। তুমি আমার সবকিছু নিয়ে গেছ, আমি এখন ওই ফাঁকা বাড়িতে কী করব? তাই আমিও চললাম তোমার সঙ্গে।

চোর উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করুন, আমি তোমার সবকিছু ফেরত দিচ্ছি।

গৃহকর্তা হেসে বললেন, ‘তার আর দরকার নেই। আমি এমনিতেই বাড়ি বদলের কথা ভাবছিলাম। বাড়িটি প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম। তা ছাড়া, আমি বৃদ্ধ, আমার দেখভালের জন্য একজন দরকার। যখন আমার সবই নিয়ে গেছ, তখন আমাকেও একা ফেলে যেও না!

চোর এবার আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। সারা জীবন চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত থেকেও সে কখনও এমন মানুষের দেখা পায়নি। সে বলল, ‘না, না! তুমি তোমার সবকিছু ফেরত নাও!

গৃহকর্তা স্থির গলায় বললেন, ‘তা হবে না। তোমাকে সবকিছু নিতেই হবে, নইলে আমি পুলিশে খবর দেব। এতক্ষণ আমি ভদ্রতা করেছি, তোমাকে চোর বলিনি। বরং একজন মানুষ হিসেবে গণ্য করেছি, যে আমাকে বাড়ি বদলাতে সাহায্য করছে।



গল্পটি রূপকধর্মী। এখানে চোর হরির প্রতীক। হরি, যিনি হরণ করেন। হরির আরেক নাম যম — মৃত্যুর দেবতা। তাই হিন্দুরা শববহন ও শবদাহের সময় ‘হরিবোল’ ধ্বনি উচ্চারণ করে

মৃত্যুরূপী হরি নিশীথরাতে চোরের মতো চুপিসারে মানুষের দেহঘরে প্রবেশ করে। সমস্ত ঐশ্বর্য — প্রাণশক্তি, মেধা, স্মৃতি — সব হরণ করে নিয়ে যায়। ফলে দেহঘর শূন্য হয়ে পড়ে, বাসের অনুপযুক্ত হয়। তখন মানুষ নিজেকে মৃত্যুর হাতে সমর্পণ করে, এবং মৃত্যু তাকে পৌঁছে দেয় নতুন ঠিকানায়, নতুন জীবনে। সেই ভাবনাই কবিগুরু ব্যক্ত করেছেন —

মরণ বলে, ‘আমি তোমার জীবন-তরী বাই’।”

অর্থাৎ, মৃত্যু জীবনকে বহন করে চলে জন্ম থেকে জন্মান্তরে

মানুষ অন্তত দুইবার বাড়ি বদল করে — প্রথমবার, যখন সে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়; আর শেষবার, যখন দেহঘর ছেড়ে পরলোকগমন করে। বাড়ি বদল তাই জীবনের অবশ্যম্ভাবী সত্য। মৃত্যু এক দেহ থেকে আরেক দেহে, এক চেতনার স্তর থেকে অন্য স্তরে পৌঁছে দেয়

মানুষের মৃত্যু আকস্মিক কোনও ঘটনা নয়। বিশ্বপ্রকৃতিতে তার জন্য থাকে বিশাল আয়োজন। কবিগুরুর কবিতায় সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট —

ভুবন বলে ‘তোমার তরে আছে বরণমালা’,

গগন বলে ‘তোমার তরে লক্ষ প্রদীপ জ্বালা’।
প্রেম বলে ‘যুগে যুগে তোমার লাগি আছি জেগে’,
মরণ বলে ‘আমি তোমার জীবনতরী বাই’।”

কী অসাধারণ চিত্রকল্প! মৃত্যু আমার জীবনতরী বয়ে নিয়ে চলেছে। বিশ্ব বরণমালা হাতে প্রস্তুত। গগনে লক্ষ তারার প্রদীপ জ্বলছে। যুগে যুগে প্রেম অপেক্ষা করে আছেযদি মৃত্যুর পরিণতি এতটাই সুন্দর হয়, তবে কেন ভয়? বরং বলা যেতে পারে —

হে মৃত্যু, সময় হল! এসো নোঙর তুলি, কান্ডারীচলো প্রস্তুত হই। যদিও আকাশ-সমুদ্র আঁধারে ঢাকা, তুমি তো জান আমাদের প্রাণের সৈকত রৌদ্রময়!

Popular posts from this blog

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চেনার উপায়

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা — চন্দ্রসূর্যের মিলন ও বিরহ তিথি

তেলের সামাজিক মাহাত্ম্য

ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ

রাসলীলা মাহাত্ম্য

আঁধারের রূপ ও বিপন্নতা

আধ্যাত্মিকতা — পাশ্চাত্য ভাবধারার আলোকে

সূর্য উপাসনা

হৃদয়-দর্পনে দেখা