গাছের পাতা ও অনিঃশেষ জীবন

গাছের শাখা-প্রশাখা থেকে উদগত সবুজ পাতা গাছের অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাতা গাছের জৈবজীবনে শক্তি যোগায় গাছের সৌন্দর্য, ছায়াময় স্নিগ্ধতা পাতার অবদান গাছ পাতাকে জন্ম দেয়, আর পাতা গাছকে দেয় পূর্ণতা গাছ ও পাতা এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের বন্ধনে বাঁধা এমনকী পাতা ঝরে গেলেও সে-সম্পর্ক বজায় থাকে

পাতার প্রধান কাজ গাছের জন্য খাদ্য উৎপাদন করা গাছের পাতায় থাকে সবুজ রঞ্জক পদার্থ ক্লোরফিল বা পত্রহরিৎ যা সূর্যের আলো শোষণ করে শোষিত আলোকশক্তি ব্যবহার করে জল ও বাতাসের সংশ্লেষে খাদ্য উৎপাদিত হয়

খাদ্য উৎপাদনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও গাছের পাতা স্বল্পায়ু পরিবেশে বৈরী হলে পাতাকে ঝরে পড়তে হয় শীতঋতুতে দিন ছোট হয়ে আসে স্বল্প আলোয় খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হয় না ফলে পাতার কাজ ফুরিয়ে যায় তখন গাছ পাতায় সঞ্চিত সবুজ রং সরিয়ে নেয় আর অমনি, এতদিন সবুজের আড়ালে থাকা অন্যান্য রং নিজেদের প্রকাশ করার সুযোগ পায় দেখে মনে হয় যেন বড় বড় গাছের পাতায় রঙের উৎসব শুরু হয়েছে কোনও গাছে লাল, কোনও গাছে হলদে, কোনও গাছে কমলা রঙের মেলা তবে পত্ররাজির এই বর্ণাঢ্য উৎসব ক্ষণকালের অচিরেই শুরু হয় পাতা ঝরার পালা

Autumn leaves

পাতার আর একটি কাজ হচ্ছে বাস্পমোচন অনুকূল পরিবেশে গাছ তার শিকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে অবিরাম জল শোষণ করতে থাকে সেই জলের কিছু অংশ গাছ ব্যবহার করে আর বেশির ভাগ অংশই পাতার মাধ্যমে বাস্পাকারে দেহের বাইরে নির্গত করে দিনের বেলায় বাস্পমোচনের মাধ্যমে পাতা গাছকে প্রখর সূর্যতাপ থেকে রক্ষা করে কিন্তু শীতকালে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় মাটির আর্দ্রতা কমে যায় তখন বাস্পমোচনে জলের অপচয় বন্ধ করতে পাতারা ঝরে পড়ে

ছোট দিন আর শুস্ক আবহাওয়া শুরু হওয়ার আগেই গাছ কয়েক মাস চলার মতো খাদ্য সঞ্চয় করে রাখে শীতকালে যখন গাছ কৃচ্ছ্রসাধনায় মগ্ন হয় তখন গাছের জন্য সঞ্চিত সীমিত রসদে ভাগ না বসিয়ে পাতারা মাটিতে ঝরে পড়ে

হেমন্ত ও শীতে যে-গাছের পাতা ঝরে তার নাম পর্ণমোচী বৃক্ষ বাংলার শাল, সেগুন, বট, অশথ, শিরিষ, মহুয়া, শিমুল, পলাশ এই ধরণের গাছ শীতকাল শুস্ক বলে এদের পাতা শীতে ঝরে পড়ে এমনকী, চিরহরিৎ বা চিরসবুজ গাছেরও পাতা ঝরে তবে একসঙ্গে ঝরে না এবং পুরোনো শুকনো পাতা ঝরার সঙ্গে সঙ্গে নতুন কচি পাতা জন্ম নেয় তাই এরা সারা বছর ঘন সবুজ পাতায় ঢাকা থাকে

গাছ ভেদে পাতার আয়ু বিভিন্ন হতে পারে তবে সব পাতাকে একদিন-না-একদিন ঝরে পড়তেই হয় সেটাই ভবিতব্য পাতা গাছের মতো দীর্ঘায়ু নয় একটি অশথ গাছ হয়তো হাজার বছর বেঁচে থাকে, কিন্তু তার পাতারা প্রতি বছর নতুন করে জন্ম নেয় এইভাবে নতুন নতুন সবুজ পাতা এসে প্রবীণ বৃক্ষকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখে         

পাতা ঝরা একটি বৃক্ষের জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা তবুও কি বিরহবিধুর নয় ঝরে পড়ার মুহূর্তটি? ঝরার বেলায় বিদায়কালীন কী কথা হয় বৃক্ষ আর পাতার মধ্যে?

বৃক্ষ ঝরাপাতাকে বলে তুমি দুঃখ করো না ভেবো না, মরে যাচ্ছ তুমি বেঁচে থাকবে আমার মধ্যে আমি যে আজ বেঁচে আছি সে তো তোমারই কল্যাণে তোমার তৈরি পুষ্টিতে গড়া আমার দেহ তোমার প্রাণরস মিশে আছে আমার প্রাণরসে তোমার দেওয়া প্রাণরসের সঞ্চয় আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে আরও কিছুদিন

ঝরাপাতা বৃক্ষকে বলে — না, আমার কোনও দুঃখ নেই সারাটা বসন্ত-গ্রীষ্ম-বর্ষা আমি সংযুক্ত ছিলাম তোমার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করে তোমার সেবা করেছি, তোমার পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় আহার তৈরি করেছি, তোমাকে প্রখর সূর্যতাপ থেকে রক্ষা করেছি আর ঝরে পড়ার পর যখন মাটির সঙ্গে মিশে যাব তখন জৈবসার হয়ে তোমার দেহে প্রবেশ করব, তোমার বিকাশ-বৃদ্ধিতে সাহায্য করব তার পর অনুকূল পরিবেশে তোমার ডালে জন্ম নিব আবার তোমার সেবায় নিজেকে নিবেদন করব সুতরাং, হে বৃক্ষদেব, বিদায় মাত্র তো কয়েক মাসের ব্যাপার, শীঘ্রই আবার দেখা হবে

একটি পাতার জীবনচক্রে থাকে — বসন্তে বনবৃক্ষের ডালে জন্ম নেওয়া, সারা বছর গাছের সেবা করা, হেমন্তে জীবনের রং খেলা শেষ করে মাটির টানে ঝরে পড়া তার পর মাটির সঙ্গে মিশে গাছের সেবা করা এবং বসন্তে নিস্পত্র বনডালে আবার আত্মপ্রকাশ করা সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পাতার জীবন এক অবিরাম চলমান প্রক্রিয়ার নাম যে-জীবন কখনও নিঃশেষ হয় না, শুধু রূপ পালটায়

অনিঃশেষ জীবনের প্রতীক গাছের পাতা কেবল উপযোগিতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চক্রাকারে প্রবাহিত হয় পাতার জীবন — সবার জীবন। 


অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা 

Popular posts from this blog

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চেনার উপায়

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা — চন্দ্রসূর্যের মিলন ও বিরহ তিথি

তেল মাহাত্ম্য

ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ

রাসলীলা মাহাত্ম্য

আঁধারের রূপ ও বিপন্ন অন্ধকার

আধ্যাত্মিকতা — পাশ্চাত্য ভাবধারার আলোকে

সূর্য উপাসনা

হৃদয়-দর্পনে দেখা