বাক্-দেবী সরস্বতী
মানুষই একমাত্র প্রাণী যে কথা বলতে পারে। পশু-পাখিরাও কথা বলে বটে, কিন্তু তাদের কথা অন্যরকম। তারা মানুষের মতো ধ্বনি এবং শব্দের স্পষ্ট উচ্চারণ করতে পারে না। তারা কয়েকটি ধ্বনি (বর্ণ) দিয়ে শব্দ এবং কয়েকটি শব্দ দিয়ে অর্থজ্ঞাপক বাক্য তৈরি করতেও পারে না।
মানুষ কথা বলতে
সক্ষম হয়েছে তার বাগযন্ত্রের কারণে। মানুষের বাক্-যন্ত্র বিশেষ একটি
প্রত্যঙ্গ নয়, অনেকগুলো প্রত্যঙ্গের সমাহার। এর মধ্যে রয়েছে ফুসফুস, স্বরতন্ত্রী (ভোকাল কর্ডস), ধ্বনিদ্বার (ভোকাল
ফোল্ডস), মুখ, ঠোঁট, জিহ্বা, দাঁত, নাক। এতগুলো
প্রত্যঙ্গ সাহায্য করে বলেই মানুষ কথা বলতে পারে। অতএব, কথা বলা মোটেও সহজ কাজ নয় — বহু
প্রত্যঙ্গের সমন্বিত কর্মের ফল। উল্লেখ্য, মানুষকে কথা বলতে সাহায্য করাই এই
সমস্ত প্রত্যঙ্গের এক মাত্র কাজ নয়, আরও বহুবিধ কাজ তাদের
করতে হয়।
প্রশ্ন এই — মানুষের
এই বাক্-সক্ষমতা কি প্রকৃতির দান? মানুষ কি প্রাকৃতিক নির্বাচনের
মাধ্যমে অর্জন করেছে এই সক্ষমতা? বিবর্তনবাদীরা বলবেন —
হ্যাঁ। কিন্তু আর একদল বিজ্ঞানী আছেন যারা
মনে করেন, শুধু প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে এতো জটিল ও উন্নত
সক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই কোনও ‘ইন্টেলিজেন্স’ এর পিছনে কাজ করেছে।
যে-ভাবেই অর্জিত
হয়ে থাক না কেন, এ-কথা ঠিক যে, বাক্-সক্ষমতা
মানব সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বাক্-সক্ষমতার কারণে সৃষ্টি হয়েছে কথা, কথা থেকে সৃষ্টি হয়েছে ভাষা। আর ভাষা সৃষ্টি হয়েছে বলেই আজ মানুষ জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে এতো উন্নতি করতে পেরেছে। কারণ,
ভাষা ছাড়া মানুষ চিন্তা করতে পারে না। ভাষা ছাড়া আমরা হয়তো একটি গাছের ছবি
মনে আনতে পারি।
কিন্তু গাছ সংক্রান্ত বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন-চিন্তা
ভাষা ছাড়া একদম সম্ভব না। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, — [আমাদের] ‘সমস্ত
কাব্য, চিত্রবিদ্যা ও সংগীত কেবল ভাষা, বর্ণ ও ধ্বনির মধ্য দিয়ে ভাবের অভিব্যক্তি
ছাড়া আর কিছুই নয়।’
বাকশক্তির কারণেই মানুষ সৃজনশীল হয়েছে, সভ্যতা নির্মাণ করতে পেরেছে। এই বাকশক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম বাগদেবী বা সরস্বতী। তিনি বাক্ বা কথার দেবী। যেহেতু কথা থেকেই ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, সংগীত ইত্যাদি সৃষ্টি হয়, তাই তিনি এসবেরও দেবী।
উল্লেখ্য, সরস্বতীর নামে কোনও মন্দির নির্মাণ করা হয় না। কোথায় নির্মাণ করবে মন্দির! তার
অধিষ্ঠান যে মানুষের বাগযন্ত্রের ভিতরে। বাগযন্ত্র থেকেই ফোটে কথার ফুল। সুতরাং বাগযন্ত্রই হতে পারে সরস্বতীর
প্রকৃত মন্দির।
স্বামী বিবেকানন্দের দেববাণীতে আছে — ‘হে মাতঃ বাগীশ্বরি, তুমি স্বয়ম্ভু, তুমি
আমার জিহ্বায় বাক্-রূপে আবির্ভূতা হও!’
বাগদেবীর
উদ্দেশে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ‘শ্রীপঞ্চমী’ কবিতায় বলেছেন —
শ্রীপঞ্চমী
তিথিতে, আমরাও আমাদের হৃদয়-বনে ফোটা ফুল দেবীর ওই রাঙা চরণে
নিবেদন করব! ▣